Skip to content Skip to sidebar Skip to footer

মহাবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল: (The Revolt of 1857).

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অসন্তোষের কারণে সিপাহি বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহের সূচনা ঘটলেও কোম্পানির অপশাসনের বিরুদ্ধে দেশবাসীর ক্ষোভ প্রকাশ পায় মহাবিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ শাসনে নির্যাতিত বিভিন্ন শ্রেণির ক্ষোভের ফল ছিল মহাবিদ্রোহ। স্বাধীনতা সংগ্রামী দামোদর সাভারকর মহাবিদ্রোহকে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলে উল্লেখ করেছেন।





মহাবিদ্রোহের কারণ:
● মহাবিদ্রোহের রাজনৈতিক কারণ:

(i) স্বত্ববিলোপ নীতি: গভর্নর-জেনারেল লর্ড ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে বহু দেশীয় রাজ্য গ্রাস করেন। এভাবেই একে একে ঝাঁসি, সাতারা, তানজোর, নাগপুরসহ বিভিন্ন রাজ্য ব্রিটিশ সরকার গ্রাস করে।

(ii) রাজপ্রাসাদ লুণ্ঠন: কুশাসনের অজুহাতে ব্রিটিশ অযোধ্যা ও নাগপুরের রাজপ্রাসাদ লুঠ করে। ব্রিটিশ বাহিনী অযোধ্যায় নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ ও তাঁর আত্মীয়দের রাজপ্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দেয় এবং নাগপুরের ভোঁসলে রাজপরিবারের অবসান ঘটিয়ে প্রচুর সম্পদ লুণ্ঠন করে। এরপর তারা নবাব ও তাঁর আত্মীয়দের রাজপ্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দিলে জনগণ ব্রিটিশের উপরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।


● মহাবিদ্রোহের সামাজিক কারণ:

(i) সামাজিক বৈষম্য: সামাজিক দিক থেকে ইংরেজরা ছিল শাসক এবং ভারতীয়রা ছিল শাসিত। এই বৈষম্য ভারতবাসীর চেতনাকে জাগ্রত করতে সাহায্য করে।

(ii) ভারতীয়দের প্রতি ঘৃণা: ভারতীয়রা ব্রিটিশের চোখে ছিল ঘৃণার পাত্র। বহু ইউরোপীয় পার্ক ও ক্লাবে লেখা থাকত ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ'। আগ্রার এক ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট আইন জারি করে বলেছিলেন, 'প্রত্যেক ইংরেজকেই ভারতবাসী সেলাম জানাবে।'

● মহাবিদ্রোহের ধর্মীয় কারণ:

(i) বিভিন্ন প্রথার বিরোধিতা: সতীদাহপ্রথা এবং গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রথা রদ, শিশুহত্যা নিবারণ, বিধবাবিবাহ প্রচলন ইত্যাদিতে ইংরেজদের ইতিবাচক ভূমিকায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতবাসী যথেষ্ট অসন্তুষ্ট হয়।

(ii) ধর্মীয় কর আরোপ: বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর কর চাপানো হলে ভারতবাসীর ধর্মবিশ্বাসে আঘাত লাগে। বিভিন্ন মন্দির ও মসজিদের জমির ওপর নির্ভরশীল হিন্দু-মুসলিম পরিবারগুলি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।


● মহাবিদ্রোহের অর্থনৈতিক কারণ:

(i) কুটিরশিল্প ধ্বংস: ব্রিটিশ নিজেদের স্বার্থে ভারতের তাঁতশিল্পকে ধ্বংস করে। ইংল্যান্ডের শিল্পজাত দ্রব্য বিনাশুল্কে ভারতে আমদানি করে। ভারতকে কাঁচামাল সরবরাহের দেশে পরিণত করে।

(ii) চাকুরিতে বঞ্চনা: ভারতবাসীদের দুর্নীতিগ্রস্ত ভেবে সরকারি উচ্চপদগুলি থেকে তাদের বঞ্চিত করে সেগুলি শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। এতে ভারতীয়দের ক্ষোভ বাড়ে।


● মহাবিদ্রোহের সামরিক কারণ:

(i) নৌসেনাদের অভদ্রতা: ব্রিটিশ নৌ-অফিসাররা ভারতীয় সিপাহিদের কারণে-অকারণে গালিগালাজ করত। ব্রিটিশ অফিসারদের এই আচরণ সিপাহিদের অত্যন্ত ক্ষুব্ধ করে তোলে।

(ii) অন্যান্য সুযোগসুবিধার অভাব: ব্রিটিশ সেনা ও ভারতীয় সিপাহিদের মধ্যে যথেষ্ট বেতন-বৈষম্য ছিল। এ ছাড়াও ভারতীয় সিপাহিদের অতিরিক্ত ভাতা দেওয়া হত না বা তাদের কোনো পদোন্নতি হত না।


● মহাবিদ্রোহের  প্রত্যক্ষ কারণ:

ব্রিটিশ সরকার এনফিল্ড রাইফেল নামে এক নতুন বন্দুকের ব্যবহার চালু করে। এই বন্দুকের টোটা দাঁতে কেটে বন্দুকে ভরতে হত। গুজব রটে যে, হিন্দু ও মুসলমান সৈনিকদের ধর্মনাশের জন্য গোরু ও শূকরের চর্বি দিয়ে এই টোটা তৈরি করা হয়েছে। এতে ভারতীয় মুসলিম ও হিন্দু সিপাহিরা ধর্মনাশের আশঙ্কায় সিপাহি বিদ্রোহ ঘোষণা করে।



১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ বা সিপাহি বিদ্রোহের প্রভাব পড়েছিল পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এই মহাবিদ্রোহ পরবর্তী সময়ের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে ও ব্রিটিশ প্রশাসনে তার ছাপ ফেলেছিল।


মহাবিদ্রোহের ফলাফল:

● কোম্পানির শাসনের অবসান:
মহাবিদ্রোহের পর ব্রিটেনের পার্লামেন্ট ভারতের শাসনভার আর কোম্পানির হাতে রাখতে সাহস পেল না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে 'ভারতশাসন আইন পাস’ হল। এই আইনের মাধ্যমে কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটিয়ে মহারানি ভিক্টোরিয়ার হাতে ভারতের শাসনভার তুলে দেওয়া হল। স্থির হল মহারানির প্রতিনিধিরূপে একজন গভর্নর-জেনারেল ভারত শাসন করবেন।

শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন:
এক কাউন্সিল আইন পাস করে পূর্বেকার সনদ আইনের কেন্দ্রীকরণ নীতির প্রস্তাব বাতিল করা হয়। ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসনকে আরও বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা শুরু হয়। মুম্বাই ও মাদ্রাজ কাউন্সিলকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়। স্থির হয় ভারত-সচিবকে শাসন পরিচালনায় সাহায্য করবে পনেরো সদস্যবিশিষ্ট ইন্ডিয়া কাউন্সিল।

সামরিক সংস্কার:
মহাবিদ্রোহের পর সামরিক বিভাগকে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে বিদেশি সেনার সংখ্যা বাড়ানো হয়। গোলন্দাজ বাহিনীতে ভারতীয় সেনাদের নিয়োগ বন্ধ করা হয়। প্রেসিডেন্সি সেনাবাহিনীকে আলাদা করে দেওয়া হয়। ভারতীয় সেনাদের সেনাবাহিনীর উচ্চপদে নিয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

দেশীয় রাজনীতিতে পরিবর্তন:
মহাবিদ্রোহের আগে দেশীয় রাজ্যগুলি রক্ষার অজুহাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়েছিল। এখন থেকে দেশীয় রাজ্যগুলি সম্পর্কে বন্ধুত্বপূর্ণ নীতি নেওয়া হয়, যাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়।

সামাজিক পরিবর্তন:
মহাবিদ্রোহ ভারতের সামাজিক ক্ষেত্রেও বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটায়। পাশ্চাত্য দর্শন, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের স্পর্শে ভারতীয় সমাজ আধুনিক হয়ে উঠতে শুরু করে। হিন্দুরা পাশ্চাত্য-প্রভাবে আধুনিক হয়ে উঠলেও মুসলমানরা পাশ্চাত্য প্রভাব থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে।

মহারানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণা:
উন্নততর ভারত শাসন আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহারানি ভিক্টোরিয়ার প্রতিনিধিরূপে সর্বপ্রথম ভারতে ভাইসরয় হন লর্ড ক্যানিং। নবনিযুক্ত ভাইসরয় ক্যানিং এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত এক দরবারে মহারানির হয়ে এক ঘোষণাপত্র পাঠ করেন (১ নভেম্বর, ১৮৫৮ খ্রিঃ), যা ‘মহারানির ঘোষণাপত্র’ নামে পরিচিত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন for "মহাবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল: (The Revolt of 1857)."