Skip to content Skip to sidebar Skip to footer

নীল বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল: (Indigo revolt).

বাংলার কৃষক  বিদ্রোহের  ইতিহাসে একটি  অতি উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দের নীল বিদ্রোহ। ঊনবিংশ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ভারতে আগত নীলকর সাহেবরা বাংলায় বিভিন্ন অঞ্চলে নীলের লাভজনক ব্যবসা শুরু করেন। তাদের শোষণ ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলার নীল চাষিরা সংঘবদ্ধভাবে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তা ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।


নীল বিদ্রোহে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের ভূমিকা:-
নীল চাষীদের উপর অকথ্য নির্যাতনের বিরুদ্ধে ও নীলচাষীদের পক্ষ নিয়ে তৎকালীন বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একাংশ সরকারের বিরুদ্ধে সরব হন। 'হিন্দু প্যাট্রিয়ট' পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নীল চাষীদের পক্ষে কলম ধরেন এবং প্রতিটি নীলকুঠি বন্ধ করা তথা উঠিয়ে দেওয়া উচিত বলে মত প্রকাশ করেন। 'ক্যালকাটা রিভিউ' পত্রিকায় নীলকরদের 'ভাগ্যান্বেষী ও দুর্বৃত্ত শ্রেণীর মানুষ' বলে অভিহিত করা হয়। দীনবন্ধু মিত্র তাঁর 'নীলদর্পণ' নাটক নীল চাষীদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের মর্মস্পর্শী কাহিনী তুলে ধরেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই নীলদর্পণ নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করে রেভারেন্ড জেমস লঙের নামে প্রকাশ করলে লং সাহেবের এক মাস কারাদণ্ড ও ১০০০ টাকা জরিমানা হয়। গিরিশচন্দ্র ঘোষ, শিশির কুমার ঘোষ, কিশোরী চাঁদ মিত্র, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রমূখ শিক্ষিত মানুষেরা নীলচাষীদের নানাভাবে সহযোগিতা ও উৎসাহিত করেন।





নীল বিদ্রোহের সূচনা ও বিস্তার:-
নীলকর  সাহেবদের অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে নদিয়ার চৌগাছা গ্রামে সর্বপ্রথম নীল বিদ্রোহের সূচনা হয়। ক্রমে বিপ্লবের আগুন সমগ্র নদীয়া, যশোর, খুলনা, পাবনা, ফরিদপুর, রাজশাহী, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর, বারাসাত প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৬০ লক্ষ কৃষক বর্শা, তরবারি, বাঁশের লাঠি ও ঢাল নিয়ে এই বিদ্রোহে সামিল হয়। এই বিদ্রোহের প্রথম পর্যায়ে নীলচাষরা নীলকরদের শোষণ ও অত্যাচারের কথা জানিয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষকে প্রতিকারের জন্য আবেদন জানায়। এতেও কোনো ফল না হওয়ায় বিদ্রোহের দ্বিতীয় পর্যায়ে নীলচাষীরা নীল চাষের জন্য দাদন নিতে অস্বীকার করে এবং নীল চাষ বয়কট করে। তাদের বলপূর্বক নীলচাষে বাধ্য করা শুরু হলে বিদ্রোহের তৃতীয় পর্যায়ে নীলচাষীরা সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এরপর নীলকর সাহেবরা নীল চাষীদের উপর আক্রমণ করলে নীলচাষীরাও প্রতি আক্রমণের পথ ধরে। নীলকর সাহেবরা কোন গ্রাম আক্রমণ করলে এক গ্রামের কৃষকরা ঢাক, ঢোল, ঘন্টা বাজিয়ে ও শঙ্খধ্বনি করে অন্য গ্রামের গ্রামবাসীদের সতর্ক করে দিত এবং নারী-পুরুষ সমবেতভাবে নীলকর সাহেবদের পাইক, বরকন্দাজ ও লাঠিয়ালদের লাঠি ও গুলির মোকাবেলা করতে। বিদ্রোহী কৃষকরা নীলকুঠি আক্রমণ করে জ্বালিয়ে দিয়ে দিত। পথে-ঘাটে নীলকর সাহেবদের লাঞ্চিত করত এবং নীলকর সাহেবদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় রসদের যোগান বন্ধ করে দিত। এমনকি অনেক সময় নীলচাষীরা নিজেরাই নিজেদের জমির নীলের চারা নষ্ট করে। এইভাবে সমগ্র বাংলা জুড়ে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে নীল বিদ্রোহ চলতে থাকে।


নীল বিদ্রোহের কারণ:-
নীলকরদের অত্যাচার: নীলকররা নীলচাষিদের নানাভাবে অত্যাচার করে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। অনিচ্ছুক চাষিদের প্রহার করা, আটকে রাখা, স্ত্রী-কন্যার সম্মানহানি করা, চাষের সরঞ্জাম লুঠ করা, ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া প্রভৃতি নানাভাবে চাষিদের অত্যাচার করত।

দাদন প্রথা: নীলকররা চাষিদের দাদন বা অগ্রিম অর্থ দিত। অভাবের সময় চাষিরা অগ্রিম নিত। প্রতি বিঘায় ২ টাকা অগ্রিম দিয়ে চাষির সবচেয়ে ভালো জমিতে নীলচাষ করাতে বাধ্য করত। একবার কেউ দাদন নিলে সে আর নীলচাষের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারত না।

প্রতারণা ও কারচুপি: নীলকররা নীলচাষিদের বিভিন্নভাবে প্রতারিত করত। নীল কেনার সময় নীলের ওজন কম দেখাত, কম দামে নীল বিক্রি করতে বাধ্য করত; তা ছাড়া জোর করে বিভিন্নভাবে অর্থ আদায় করত।

পঞ্চম আইন: ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক পঞ্চম আইন পাস করে ঘোষণা করেন যে, কোনো চাষি দাদন নিয়ে নীলচাষ না করলে তাকে গ্রেফতার করা হবে ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। এর ফলে নীলচাষিদের উপর অত্যাচার অনেক বেড়েছিল।

অবিচার: অত্যাচারিত নীলচাষিরা আদালতে গিয়েও সুবিচার পেত না। আইন ছিল নীলকরদের স্বার্থরক্ষার জন্য, চাষিদের জন্য নয়। তাছাড়া পুলিশ, প্রশাসন সবই ছিল নীলকরদের পক্ষে।

পত্রপত্রিকার প্রভাব: নীলচাষিদের উপর নীলকরদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের কথা সে সময়কার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও লেখায় প্রকাশিত হয়েছে। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা এবং দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ' নাটক-এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।


নীল বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ:-
দরিদ্র নীল চাষী ছাড়াও সম্পন্ন কৃষক, জোতদার, ছোট জমিদার সকলেই নীল বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলো। নদীয়ার বিষ্ণুচরন বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস, আসননগরের মেঘাই সর্দার, খুলনার কাদের মোল্লা, পাবনার মহেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, মালদহের রফিক মন্ডল, বাঁশবেড়িয়ার বৈদ্যনাথ সর্দার ও বিশ্বনাথ সর্দার এবং নড়াইলের জমিদার রাম রতন মল্লিক, চন্ডিপুরের জমিদার শ্রীহরি রায়, রানাঘাটের জমিদার শ্রীগোপাল পাল চৌধুরী, সাধুহাটির জমিদার মথুরানাথ আচার্য প্রমুখ নীল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। এদের মধ্যে দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরন বিশ্বাসকে ইংল্যান্ডের কৃষক বিদ্রোহের নেতার সঙ্গে তুলনা করে 'বাংলার ওয়াট টাইলার' বলে অভিহিত করা হয় এবং নীল বিদ্রোহে নেতৃত্বদান করার জন্য রাম রতন মল্লিককে 'বাংলার নানাসাহেব' বলে অভিহিত করা হয়।


নীল বিদ্রোহের ফলাফল:-
নীল বিদ্রোহের ফলে সরকার ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর নীল তদন্ত কমিশন গঠিত হয়।


কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে নীল চুক্তি আইন রদ করা এবং নীলচাষ সম্পূর্ন চাষীদের ইচ্ছাধীন হয়। নীলকররা এখানে নীলচাষে অর্থ বিনিয়োগ বন্ধ করে বিহার ও পার্বত্য এলাকায় চা শিল্পে বিনিয়োগ করতে শুর করে।


নীল বিদ্রোহের সাফল্য বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রসারে সহায়তা করেছিল। শিশির কুমার ঘোষ লিখেছেন, 'নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম - ভারতবাসীকে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা শিখিয়েছিল'।



নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য:-
নীলকর বিরোধী বিদ্রোহ: নীল বিদ্রোহ ছিল নীলকরবিরোধী বিদ্রোহ এটি অন্যান্য বিদ্রোহের মতো জমিদার বা মহাজনবিরোধী বিদ্রোহ ছিল না। নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচার ও জোরজবরদস্তির বিরুদ্ধে নীলচাষিরা সংঘবদ্ধ হয়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল নীলচাষ প্রথার পুরোপুরি অবসান ঘটানো


কৃষকদের কঠোর মনোভাব: নীল বিদ্রোহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল কৃষকদের কঠোর মনোভাব। এই বিদ্রোহে কৃষকরা দৃঢ়তার সঙ্গে মনস্থির করেছিল যে, মরব তবু নীলচাষ করবনা। শেষপর্যন্ত বিদ্রোহী কৃষকরা বাংলা থেকে নীলচাষ বন্ধ করেছিল।

আন্দোলনে প্রথম ধর্মঘটের প্রয়োগ: এল নটরাজন বলেছেন, নীলচাষ করতে অস্বীকার করে বাংলার কৃষকরা ভারতের ইতিহাসে প্রথম ধর্মঘটের নজির সৃষ্টি করে। ভারতে কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে এই ঘটনা ছিল অভিনব।

ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্রোহ: ওয়াহাবি, ফরাজি, সাঁওতাল, মুণ্ডা প্রভৃতি বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ধর্ম। কিন্তু নীল বিদ্রোহে তা  ছিল না।নীল বিদ্রোহ ছিল মূলত কৃষকদের অধিকার রক্ষার বিদ্রোহ। নীল বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান সব সম্প্রদায়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে শামিল হয়েছিল।

বিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারিদের সমর্থন: নীল বিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারিরা  বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছিল। তারা নীলচাষিদের উপর নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল। জেমস লঙ নীলদর্পণ নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এজন্য তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছিল।



নীল বিদ্রোহের অবসান:-
সমগ্র বাংলা জুড়ে নীল বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়লে বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার উপদ্রুত অঞ্চলে পুলিশ ও মিলিটারি পাঠায়। যশোর টু নদীয়া জেলায় দুটি ছোট ছোট ছোট রণতরীও পাঠানো হয়। কিন্তু তা সত্বেও বিদ্রোহ দমন করা না গেলে একাদশ আইন পাশ করে সরকার ঘোষণা করেন যে নীলকর সাহেবদের কাছ থেকে দাদন নিয়েছে এমন কৃষক নীলচাষ না করলে তাদের বিঘা প্রতি দশ টাকা জরিমানা দিতে হবে এবং তিন মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। তা সত্ত্বেও নীল চাষিরা বিদ্রোহের পথ পরিত্যাগ না করলে বিদ্রোহের ব্যাপকতা, গভীরতা ও বিদ্রোহের প্রতি প্রবল জন সমর্থনের কথা চিন্তা করে তৎকালীন বাংলার ছোটলাট জে.পি.গ্রান্ট পূর্ব বাংলা সফরে আসেন এবং নদীর ধারে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার নীলচাষীর করুণ অবস্থার কথা শুনে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর নীলচাষীদের করুন অবস্থা ও নীল বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধানের জন্য নীল কমিশন গঠন করেন। এই কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে বাংলায় জোর করে নীলচাষ বন্ধ হলে নীল বিদ্রোহের অবসান ঘটে।


         পরিশেষে বলা যায়, নীল বিদ্রোহ বাঙালি সমাজে ব্যাপক চাঞ্চল্য ও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় নীলচাষিদের বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিল। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তার হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় নীলচাষিদের সমর্থনে নিয়মিত লেখা প্রকাশ করতেন। তা ছাড়া অন্যান্য পত্রপত্রিকা ও নাটকে যেভাবে নীল বিদ্রোহকে সমর্থন করা হয়েছিল তা ছিল অভূতপূর্ব। 

১টি মন্তব্য for "নীল বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল: (Indigo revolt)."