Skip to content Skip to sidebar Skip to footer

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কারণ ও ফলাফল: (Great Bengal famine).

রবার্ট ক্লাইভ দ্বিতীয়বারের জন্য ভারতবর্ষে এসে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পাইয়ে দিয়েছিলেন। তিনি কোম্পানির অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা দমন করে কোম্পানির স্বার্থ সুরক্ষায় যথেষ্ট তৎপর হয়েছিলেন। কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ভারতের স্বার্থ ক্ষুন্ন করেন। বৃটিশ কর্মচারীদের সীমাহীন লোভ ভারতের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। ১৭৭০ সালে বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। সময়টি বাংলা ১১৭৬ সাল হওয়ায় এই দুর্ভিক্ষ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত হয়।





ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কারণ :

দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা :

সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে দেওয়ানি লাভ করে রবার্ট ক্লাইভ বাংলার নবাবকে বেতনভোগীতে পরিনত করেন। বাংলার ওপর সম্পূর্ণরূপে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এইসময় রবার্ট ক্লাইভ বাংলায় এক অদ্ভুত রকমের শাসন ব্যবস্থা চালু করেন যার নাম দ্বৈত শাসন। এই শাসন ব্যবস্থায় নবাবকে শাসন সংক্রান্ত দ্বায়িত্ব দেওয়া হয় কিন্তু ক্ষমতা দেওয়া হয় নি। সকল ক্ষমতা ছিল কোম্পানির অধীনে। এরফলে কোম্পানি হয়ে ওঠে দ্বায়িত্বহীন ক্ষমতার অধিকারী। ক্লাইভের পর বৃটিশ গভর্নর রূপে এসেছিলেন যথাক্রমে ভেরেলস্ট (১৭৬৭ - ১৭৬৯ খ্রীঃ) এবং কার্টিয়ার (১৭৬৯ - ১৭৭২ খ্রীঃ)। তাঁরা ইংরেজ কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ ছিলেন। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ কর্মচারীদের মধ্যে দূর্নীতি ও শোষনের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাদের মধ্যে নীতিবোধ ও মানবিকতাবোধ লুপ্ত হয়েছিল। পার্সিভাল স্পিয়ার এই সময়কালকে বৃটিশ কর্তৃক 'প্রকাশ্য ও নির্লজ্জ লুণ্ঠনের যুগ' বলে অভিহিত করেছেন। 


অত্যধিক রাজস্ব আদায় :

কোম্পানির দেওয়ানি লাভের ফলে এবং দ্বৈত শাসন চালু করা হলে বাংলার শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সমগ্র রাজস্ব ব্যবস্থায় অরাজকতা ও অনিশ্চয়তা দেখা যায়। রাজস্ব আদায়ের কোন নির্দিষ্ট সীমা ছিল না। তাই কোম্পানির কর্মচারীরা নিজেদের ইচ্ছামত কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করত। এর ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি দ্রুত ভেঙে পড়তে থাকে।


কৃষিকাজের ক্ষতি :

বাংলার অর্থনীতি নির্ভর করতো কৃষির উপর। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে এই অরাজকতার জন্য বহু কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কৃষিকাজ ছেড়ে দেওয়ার ফলে বেশীরভাগ মানুষ ভিক্ষুকে পরিনত হয় এমনকি ছোট ছোট জমিদাররাও দারিদ্র্যের মুখে পড়ে। কোম্পানির কর্মচারীদের এই শোষনের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করার ক্ষমতা নবাব (নাজিম-উদ-দৌলা)-এর ছিল না। দেওয়ানির কাজ ছিল সিতাব রায়, রেজা খাঁ প্রমুখের ওপর। তাঁরা কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করে চলতেন। সুতরাং কৃষকদের দূর্গতির কোন সমাধান সম্ভব ছিল না। নির্মমভাবে রাজস্ব আদায়ের ফলস্বরূপ সাধারণ মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। স্বয়ং রবার্ট ক্লাইভ মন্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল সর্বোচ্চ অরাজকতা ও শোষনের ক্ষেত্র। এখান থেকে যে পরিমাণ সম্পদ লুট করা হয়েছিল তা অন্য কোন দেশ থেকে করা হয়নি। গভর্নর ভেরেলেস্ট বাংলাদেশের এই বিপর্যয় সম্পর্কে চিন্তিত হয়ে ইংল্যান্ডে জানান যে, 'ব্যবসা থেকে যত খুশি লাভ করা যায়, কিন্তু জমির উৎপাদন ক্ষমতা সীমিত'। কিন্তু তাঁর এই চিন্তাকে ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ কোন গুরুত্ব দেননি। 


অনাবৃষ্টি :
একদিকে কোম্পানির মাত্রাহীন শোষণ অন্যদিকে ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দের পর টানা দু-বছর অনাবৃষ্টির ফলে বাংলা ও বিহারে কৃষিকাজের অভাবনীয় ক্ষতি হয়। মাঠের সমস্ত ফসল জলের অভাবে নষ্ট হয়ে গেলে বাংলার মাঠ-ঘাট খাঁ খাঁ করতে থাকে। ফলে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ১১৭৬ সনে সমগ্র বাংলাজুড়ে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এটিই ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত হয়। 


মহামারী :
অন্নের অভাবে মানুষ অখাদ্য খেয়ে যেকোন ভাবে বাঁচার চেষ্টা করে। এতে করে বাংলায় মহামারী দেখা দেয়। অগনিত মানুষ দূর্ভিক্ষ ও মহামারীতে মারা যায়। 




ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলাফল:

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মতো এক বিপর্যয়ের ফলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। বাংলার প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ দূর্ভিক্ষ ও মহামারীর প্রকোপে প্রাণ হারায়। গ্রামবাংলা জনশূন্য হয়ে যায়। বহু অঞ্চল জঙ্গলে পরিনত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর আনন্দমঠ উপন্যাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের করুন চিত্র বর্ণনা করেছেন। এত বেশি সংখ্যক মানুষ মন্বন্তরে মারা গিয়েছিল যে কৃষিকাজ ও শিল্পকাজে লোকের অভাব দেখা যায়। লোকের অভাবের জন্য বাংলার কুটির শিল্পগুলি কিছুদিন বন্ধ হয়ে যায়। খাদ্য ও অর্থের অভাবে মানুষ চুরি, ডাকাতি, লুটপাট আরম্ভ করে। মালদহ, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলায় দূর্নীতি চরমে পৌঁছায়। এরফলে সর্বত্র বাংলার আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। খাদ্যের অভাবে গ্রাম বাংলার মানুষ শহরমুখী হয় সামান্য খাবারের আশায়। এরফলে শহরগুলির ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এইভাবে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বাংলার সমাজ ও অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়। 

২টি মন্তব্য for "ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কারণ ও ফলাফল: (Great Bengal famine)."