স্মৃতিকথা বলতে কী বোঝায়? স্মৃতিকথার বৈশিষ্ট্য লেখো। কয়েকটি স্মৃতিকথার উদাহরণ দাও। ভারতের ইতিহাস রচনায় স্মৃতিকথার গুরুত্ব কী?


স্মৃতি বলতে মনে রাখা বিষয়কে বোঝায়, যার মধ্য দিয়ে নিকট অতীতকে স্মরণ করা যায়। কোনো ব্যক্তি তার জীবনের অনেকটা সময় অতিক্রম করার পরে তার জীবনে ফেলে আসা কোনো ঘটনার স্মৃতিচারণ ও প্রকাশকেই বলা হয় স্মৃতিকথা। এই স্মৃতিকথা হল এক ধরনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিবরণ, যেখানে লেখক তাঁর নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে অতীত কোনো ঘটনার বিবরণ দেন।

অন্যভাবে বলা যায়, স্মৃতিকথা হল এক ধরনের সাহিত্য, যেখানে লেখক তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া বা প্রত্যক্ষ করা বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ স্মৃতি থেকে এনে তুলে ধরেন।

স্মৃতিকথার বৈশিষ্ট্য:
স্মৃতিকথার যে বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করা যায়, তা হল-
ঘটনার প্রত্যক্ষ বর্ণন: স্মৃতিকথা হল প্রকৃতপক্ষে অতীত ঘটনার প্রত্যক্ষ বর্ণন। অনেক বছর পরেও তা লেখক অবিকল একইভাবে বর্ণনা করে থাকেন।

নিজস্ব অনুভূতির প্রকাশ: স্মৃতিকথা হল লেখকের নিজস্ব অনুভূতির প্রকাশ। বক্তা বা লেখক তাঁর স্মৃতিকথায় যে-কাহিনি বা ঘটনার বিবরণ দেন, তা ঘটনার সমসাময়িক কালে তাঁর মনে কীরূপ প্রভাব ফেলেছিল, তিনি কীরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন বা সেই ঘটনায় সমসাময়িক পরিস্থিতি কীভাবে পালটে যেতে দেখেছেন তা তাঁর স্মৃতিকথার আলোচনায় উঠে আসে।

ঘটনার বাস্তবতা: স্মৃতিকথা কোনো কাল্পনিক উপন্যাস নয়, এটি বাস্তব চিত্র। লেখক সাধারণত প্রকৃত ঘটনাই তাঁর স্মৃতিকথায় তুলে ধরেন বলে মনে করা হয়।

বিশেষ ঘটনার উপস্থাপন: স্মৃতিকথায় লেখকের সমগ্র জীবনের আলোচনা করা হয় না, বরং লেখকের জীবনকালে সংগঠিত সুর্নির্দিষ্ট কিছু ঘটনার ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়ে স্মৃতিকথা লেখা হয়।

স্মৃতিকথার উদাহরণ:
স্মৃতিকথার বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য উদাহরণগুলি হল-
  • বুদ্ধদেব বসু তাঁর 'আমার জীবন' নামক স্মৃতিকথায় পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশের সেই গ্রামজীবনের ঘটনাবলির ব্যাখ্যা করেছেন।
  • সাহিত্যিক সমর সেন তাঁর 'বাবুবৃত্তান্ত' গ্রন্থে তাঁর ফেলে আসা জীবনের অনেক কথাই বর্ণনা করেছেন।
  • বিপ্লবী বীণা দাশ তাঁর 'শৃঙ্খল ঝংকার' গ্রন্থে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘটনাবলি ও তাঁর জীবনের কথা বর্ণনা করেছেন।
  • নারায়ণ সান্যাল তাঁর 'আমি নেতাজিকে দেখেছি' এই স্মৃতিচারণায় প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন।

এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থগুলি হল,
মণিকুন্তলা সেন-এর 'সেদিনের কথা', আশালতা সরকার-এর 'আমি সূর্য সেনের শিষ্যা', সুফিয়া কামাল-এর 'একাত্তরের ডায়েরী', মান্না দে-র 'জীবনের জলসাঘরে', শ্রীহিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়-এর 'উদ্বাস্তু'। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'জীবনস্মৃতি', নেলসন ম্যান্ডেলার 'দ্য স্ট্রাগল ইন মাই লাইফ' প্রভৃতি।

স্মৃতিকথার গুরুত্ব:
স্মৃতিকথামূলক বিবরণগুলির ইতিহাস রচনায় যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে, যেমন-
গুণি ব্যক্তিদের বিবরণ: অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্মৃতিকথাগুলি গুণী ব্যক্তিরা রচনা করেন যা থেকে অতীতের বাস্তব ঘটনার তথ্য ও বিবরণ পাওয়া যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ: বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ঘটনার বিবরণ তাঁদের স্মৃতিকথাগুলিতে আলোচনা করেন। ফলে উক্ত বিবরণে ঐতিহাসিক তথ্যের সত্যতা অনেক বেশি থাকে।

ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে গুরুত্ব: বিভিন্ন স্মৃতিকথা বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার মূল্যবান তথ্য হিসেবে কাজ করতে পারে।

সুতরাং বলা যায়, যেখানে লিখিত ইতিহাস পৌঁছোতে পারে না সেখানেই স্মৃতিকথার প্রয়োজন হয়। স্মৃতিকথা গুরুত্বপূর্ণ, তবে - তা সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। কারণ স্মৃতিকথার তথ্য সব সময় নিরপেক্ষ হয় না।

0 মন্তব্যসমূহ