আইন অমান্য আন্দোলন: (Civil disobedience).

মহাত্মা গান্ধী, যিনি ভারতের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করেছিলেন তিনি ভারতে অনেক আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং আইন অমান্য আন্দোলন ছিল উল্লেখযোগ্য গুলির মধ্যে একটি। ১৯৩০ সালে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এই বছরে, কংগ্রেস 'পূর্ণ স্বরাজ' কে ভারতীয়দের প্রধান লক্ষ্য হিসাবে ঘোষণা করেছিল এবং ২৬ শে জানুয়ারিকে 'পূর্ণ স্বরাজ দিবস' হিসাবে পালন করা হয়েছিল। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য, আইন অমান্যকে চূড়ান্ত অস্ত্র হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। সি. রাজগোপালচারী এবং সরোজিনী নাইডুর মতো বিশিষ্ট নেতারা ছিলেন যারা দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।


আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা:
আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনার কারণগুলির মধ্যে একটি ছিল লবণ সত্যাগ্রহ। লবণ আইন ভঙ্গ করার জন্য মহাত্মা গান্ধী এবং তার অনুসারীরা ডান্ডি মার্চ পরিচালনা করেছিলেন। লবণ সত্যাগ্রহ সমুদ্রের জল থেকে লবণ আহরণের দিকে পরিচালিত করেছিল এবং এটি ডান্ডি মার্চের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল যে গান্ধীজি আইন অমান্য আন্দোলনের ঘোষণা করেছিলেন। এই আন্দোলনের ঘোষণা ভারতের জনগণকে তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার জন্য নতুন শক্তিতে পূর্ণ করে।


আইন অমান্য আন্দোলনের উদ্দেশ্য:

পূর্ণ স্বরাজ অর্জন, ভারতীয় যুবকদের বিপ্লবী আন্দোলন, সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষের ফলে অগ্নিগর্ভ ব্যবস্থার জন্যই কংগ্রেসের নতুন নেতারা পূর্ণ স্বরাজ অর্জনে লক্ষ্য স্থির করে। মাদ্রাজ অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি পেশ করা হলেও গান্ধীজী কিন্তু নেহেরু রিপোর্ট উল্লেখিত ডোমিনিয়ন সরকার পক্ষে ছিলেন। গান্ধীজী বলেন, ডোমিনিয়ন সরকার ও পূর্ণ স্বাধীনতার মধ্যে পার্থক্য নেই। যখন বড়লাট ডোমিনিয়ন দিতে অক্ষমতার প্রকাশ করেন, তখন কিন্তু ৩১ শে ডিসেম্বর গান্ধীজী পূর্ণ স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করেন।


লবণ আইন ভঙ্গ করা, কংগ্রেস গান্ধীজিকে আন্দোলনের দায়িত্ব দিয়ে দিলে গান্ধীজী সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের নতুন কৌশল স্থায়ী করলেন। ভারতের কোটি কোটি মানুষ সমুদ্রে জল শুকিয়ে লবণ তৈরি করে এবং লবণ দিয়ে আহা তৈরির করতো সমস্ত মানুষ। ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসির লবণ তৈরির অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। জল বাদ দিয়ে লবণের উপর কর নিয়ে সরকার ভারতবাসীকে শোষন করতো। গান্ধীজী লবণ আইন ভঙ্গ করে ব্রিটিশ সরকারকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যে, তাদের তৈরি আইন আর ভারতবাসী মানতে রাজি নন।


বিপ্লবী হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করা, গান্ধীজীর আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, যাতে হিংসার রাজনীতি না করে তার জন্য বিপ্লবী আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করা।


পূর্ণ স্বাধীনতার মাধ্যমে সমাজে ঐক্য স্থাপন, অধ্যাপক সুমিত সরকার বলেছেন, কৃষকদের কর দিতে বারণ করা হলে জমিদাররা দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এই ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতাবাদ যাতে জেগে উঠতে না পারে তার জন্য গ্রামের সমস্যার সঙ্গে লবণ আইন ভঙ্গের প্রশ্নকে জড়িয়ে দিয়ে একতা স্থাপন করতে চাইলেন গান্ধীজী।


সমস্ত শ্রেনীর মানুষের স্বার্থ বহন করা, গান্ধীজির আন্দোলনের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে সমস্ত শ্রেনীর মানুষের স্বার্থ বহন করা। এই জন্য তিনি ১১ দফা দাবি পেশ করে বলেন।


  • মাদক দ্রব্য বর্জন।
  • লবণ কর বিলোপ।
  • ভূমি রাজস্বের ৫০% কমানো।
  • উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বেতন ৫০% বা তার বেশি হ্রাস।
  • টাকার সাথে পাউন্ডের বিনিময় হারকে এক মিলিয়ে চারপাশে কমিয়ে আনা।
  • বিদেশি বস্ত্রের উপর শুল্ক চাপানো।
  • বৈদেশিক বাণিজ্যের মুক্তি।
  • গোয়েন্দা বিভাগ তুলে দেওয়া।
  • আত্মরক্ষার্থে আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অনুমতি দেওয়া।

অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী বলেছেন, এটা আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে গরিব সামন্ত শ্রেণীর মানুষের স্বার্থরক্ষার ফলে তাদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে গান্ধীজী আন্দোলন করতে চেয়েছিলে। এই জন্য তিনি ২১ দিন অনশন করেন, এমনকি তিনি হরিজনদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন এবং পূর্ণ স্বাধীনতা আইনের জন্য সমস্ত শ্রেনীর মানুষকে কাছে পেতে চেয়েছিলেন।

বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য বিভিন্ন কৌশল, অধ্যাপক সুমিত সরকার বলেন, যখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী গোষ্ঠী তীব্র আন্দোলন করছে, তখন গান্ধীজী আইন অমান্য আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজের মানুষের মনকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চান।


আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচি:
ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় ২৭ শে ফেব্রুয়ারি এই আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করলেন,
এগুলি হল:
১. সবরমতী আশ্রম থেকে অনুগামীদের নিয়ে পায়ে হেঁটে ডান্ডিতে উপস্থিত হয়ে লবণ আইন ভঙ্গ করা, লবণ কর না দেওয়া , সরকারি আইন অমান্য করা।

২. শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গান্ধীজী কৃষকদের কর না দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়।

৩. সমগ্র ভারতে সভা ও সমিতি করে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের অঙ্গীকার করা।

৪. বিদেশি পণ্য - বস্ত্র বয়কট করা।

৫. গ্রামাঞ্চলের গঠন মূলক কাজ করা।

৬. সমস্ত ভারতীয়দের সরকারি পদ এবং আইনসভা থেকে পদ ভাগ করা।
বলা যেতে পারে, সুভাষচন্দ্র বসু ধর্মঘট করার প্রস্তাব দিলে গান্ধীজী প্রস্তাব গ্রহণ করেনি এবং তিনি গণ আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন না। গান্ধী - আরউইন চুক্তিতে গান্ধীজী বিদেশী পণ্যের বয়কট রাজনৈতিক অস্ত্র রূপে প্রয়োগ করা হবে না, পুলিশি নির্যাতন নিয়ে অনুসন্ধান হবে না- এসব সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন।


আইন অমান্য আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য:
আইন অমান্য আন্দোলনের নির্দিষ্ট কর্মসূচি ছিল না। মুসলিম ও শিল্পপতিরা আন্দোলনে যুক্ত হয়নি। গান্ধীজী গণ আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন না এবং গান্ধী - আরউইন চুক্তির অর্থ হচ্ছে পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষ থেকে পিছু হেঁটে আসা। ব্রিটিশ সরকারের চরম দমননীতির জন্য নিরস্ত্র আন্দোলনকারীরা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ছিলেন, কমিউনিস্ট ও শ্রমিকরা আন্দোলনে যুক্ত হয়নি। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ৪ ই মে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এরফলে আইন অমান্য আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল। তবে এই আন্দোলন কিন্তু একেবারেই নিঃসফলা ছিল না। যেমন ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে লবণ আইন ভঙ্গ করা হয়, বিলিতি দ্রব্য পড়ানো হয়, কৃষকরা কর দেওয়া বন্ধ করে, অফিস - আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে পিকেটিং করা হয়, নারী আন্দোলন যুক্ত হয়, শ্রমিক এবং যুক্তিবাদীরা এগিয়ে না এলেও ব্যবসায়ী এবং কৃষকরা গান্ধীজীর আহবানে সাড়া দিয়েছিল।


আইন অমান্য আন্দোলনে ফলাফল:

আইন অমান্য আন্দোলন সফল হয় নি। গান্ধীজির নির্দেশে ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে এই আন্দোলন স্থগিত হয়। আন্দোলনের আগে তিনি বলেছিলেন “যতক্ষন পর্যন্ত একজন সত্যাগ্রহী জীবিত থাকবে ততক্ষণ আইন অমান্য চলবে।”অমলেশ ত্রিপাঠীর ভাষায়, “কিন্তু দেখা গেল সৈনিকরা সংগ্রাম চালাতে প্রস্তুত অথচ সেনানায়ক যুদ্ধ, বিরতির আদেশ দিলেন।” সুমিত সরকার লিখেছেন “গান্ধীজির মনােভাবের কেন যে পরিবর্তন হল এক ঐতিহাসিক প্রহেলিকা। “আপাত দৃষ্টিতে আইন অমান্য আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল কিন্তু এই আন্দোলনের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।

প্রথমত: আইন অমান্য আন্দোলন ছিল একটি সর্বভারতীয় আন্দোলন জাতি-ধর্ম-বর্ণ, পেশা ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শ্রমিক কৃষক দোকানদার, মধ্যবিত্ত, সর্বস্তরের ও মতাদর্শের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে যােগদান করে। বাংলার পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল লােম্যান লিখেছিলেন—“কংগ্রেস সংগঠন। এ রকম অজ্ঞ ও অশিক্ষিত লােকদের কাছ থেকে এত সহানুভূতি ও সমর্থন কি করে পেল তা আমার মাথায় ঢুকছে না।

দ্বিতীয়ত: এই আন্দোলন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ওপর প্রবল আঘাত হানে। ভারতে ব্রিটিশ পণ্যের আমদানি প্রায় এক – তৃতীয়াংশ হ্রাস পায়। বােম্বাইয়ে ইংরেজদের পরিচালিত ১৬টি বস্ত্র শিল্প বন্ধ হয়ে যায়।

তৃতীয়ত: এই আন্দোলন স্বাধীনতা প্রতি ভারতীয়দের আকাঙ্খ এবং সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকার করে তাদের প্রস্তুতির কথা প্রমাণিত করে। এই আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দের ভারত ছাড়াে আন্দোলনকে সফল করে।

চতুর্থত: এই আন্দোলনের ফলে জাতীয় কংগ্রেসের মর্যাদা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। সরকার উপলব্ধি করে যে কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে ভারতীয় সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

পঞ্চমত: এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে, কংগ্রেসই ভারতে সর্বশ্রেষ্ঠ দল –একে উপেক্ষা – করা সম্ভব নয়।

ষষ্ঠত: এই আন্দোলনের মাধ্যমে গান্ধীজি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নৈতিক চরিত্রের উন্নতি ঘটান এবং তাদের নৈতিক বলে বলিয়ান করে তােলেন।

সপ্তমত: পরােক্ষভাবে এই আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারের প্রকৃত স্বরুপ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে সরকারের মর্যাদা খর্ব করে। রজনীপাম দত্ত লিখেছেন- '১৯৩০ থেকে ১৯৩৪ এর বিরাট আন্দোলনের এমন শােচনীয় পরিণতি ঘটা সত্বেও আমরা যেন এক মুহূর্তের জন্যও এর ঐতিহাসিক কীর্তি, গভীর শিক্ষা ও অপরিসীম স্থায়ী ফলাফলের কথা বিস্মৃত না হই।'

0 মন্তব্যসমূহ