পশ্চিমবঙ্গের ভূপ্রকৃতি পরিচয়: (The topography of West Bengal).

ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও ভূমির গঠন অনুসারে পশ্চিমবঙ্গকে তিনটি ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চলে ভাগ করা যায়, যথা —
  • উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল।
  • পশ্চিমের উচ্চভূমি ও মালভূমি অঞ্চল।
  • গঙ্গার বদ্বীপ সহ সমভূমি অঞ্চল।


উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল
👉অবস্থান :- পশ্চিমবঙ্গের উত্তরদিকে পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতমালা হিমালয় অবস্থান করছে। সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালার অংশ বিশেষ পর্বতময় এই অঞ্চলটি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর-পশ্চিম সিমান্তে পূর্ব হিমালয় পর্বতশ্রেণির উপর অবস্থিত। একমাত্র শিলিগুড়ি মহকুমা বাদে পুরো দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর-পূর্বের সামান্য কিছু অংশ এই অঞ্চলের অন্তর্গত।


👉ভূপ্রকৃতি :- এই পার্বত্যভূমি তরাই-এর সমভূমি থেকে ৩০০ মিটার সমোন্নতি রেখা বরাবর হঠাৎ খাড়াভাবে উপরে উঠে গিয়েছে (সমান উচ্চতাযুক্ত অঞ্চলকে যে রেখা দিয়ে যুক্ত করা হয়, তাকে সমোন্নতি রেখা বলা হয়)।
প্রধানত পাললিক ও রূপান্তরিত শিলা দিয়ে গঠিত এই অঞ্চলটির ভূপ্রকৃতি অত্যন্ত বন্ধুর। এবড়ো-খেবড়ো পার্বত্যভূমি, পাহাড়ের খাঁড়া ঢাল, গভীর গিরিখাত এবং ছুরির ফলার মতো পর্বতশিরা এই অঞ্চলের প্রধান ভুপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য।
হিমালয় পর্বতের কয়েকটি গিরিশ্রেণি এবং উপত্যকা নিয়ে গঠিত এই অঞ্চলটি দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকের ক্রমশ উঁচু হয়ে গেছে। তিস্তা নদী সিকিম থেকে এই অঞ্চলে প্রবেশ করে সুগভীর গিরিখাত দ্বারা এই অঞ্চলটিকে দু’ভাগে ভাগ করেছে, যেমন—
  • তিস্তার পশ্চিমদিকের পার্বত্য অঞ্চল।
  • তিস্তার পূর্ব দিকের পার্বত্য অঞ্চল।
তিস্তার পশ্চিম দিকের পার্বত্য অঞ্চলটি পূর্ব দিকের পার্বত্য অঞ্চলের তুলনায় উঁচু।


👉তিস্তা নদীর পশ্চিম দিকের পার্বত্য অঞ্চল:- তিস্তা নদীর পশ্চিম দিকের পার্বত্য অঞ্চলে দুইটি পর্বতশিরা দেখা যায়, এরা হল সিংগালীলা এবং দার্জিলিং-মহালধিরাম শৈলশিরা। সিংগালিলা শৈলশিরা নেপাল ও দার্জিলিং সিমান্তে অবস্থিত থেকে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলাকে নেপাল থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। সিংগালিলার চারটি উল্লেখযোগ্য পর্বতশৃঙ্গ হলফালুট, সান্দাকফু,টংলু ও সবরগ্রাম। ফালুট পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা ৩,৫৯৫ মি, সান্দাকফু পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা ৩,৬৩০ মি., টংলু পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা ৩,০৩৬ মি., ও সবরগ্রাম পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা ৩,৫৪৩ মি। সান্দাকফু পশ্চিমবঙ্গের উচ্চতম শৃঙ্গ। দার্জিলিং-কার্শিয়াং পর্বতমালার উল্লেখযোগ্য শৃঙ্গ হলটাইগার হিল। টাইগার হিলের উচ্চতা ২,৫৬৭মি।


👉তিস্তা নদীর পূর্ব দিকের পার্বত্য অঞ্চল:- তিস্তার পূর্বদিকে রয়েছে দুরবিনদারা পর্বত। এই পর্বতটি কালিম্পং শহর এর ঢালে অবস্থিত। কালিম্পং থেকে দুরবিনদারা পর্বতটি ক্রমশ নীচু হয়ে পূর্বদিকে জলঢাকা নদীর উপত্যকার দিকে এগিয়ে গেছে। এই অঞ্চলে দার্জিলিং হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ঋষিলা অবস্থিত। ঋষিলা শৃঙ্গের উচ্চতা ৩,১৩০ মি। ঋষিলা শৃঙ্গের আরও পূর্বদিকে জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর অংশে ডলোমাইট শিলায় গঠিত নাতিউচ্চ বস্কা-জয়ন্তী পাহাড় অবস্থিত। এই অঞ্চলটি অত্যাধিক বৃষ্টিপাতের ফলে ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে বিচ্ছিন্ন পাহাড়ে পরিণত হয়েছে।


পশ্চিমের উচ্চভূমি ও মালভূমি অঞ্চল

👉অবস্থান :- পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম অংশে অবস্থিত এই ঢেউ খেলানো উঁচুভুমি ও মালভুমি অঞ্চলটি সমগ্র পুরুলিয়া জেলা এবং বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমদিকের ৫০ মিটারের বেশি উচ্চতাযুক্ত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছে । গ্রানাইট ও নাইস শিলা দ্বারা গঠিত এই উচ্চভূমি অঞ্চলটি হল ছোটনাগপুর মালভূমির অংশ বিশেষ।


👉ভূপ্রকৃতি :- সমগ্র উচ্চভূমি অঞ্চলটি দক্ষিণে বরাভূম উচ্চভূমি, পশ্চিমে পুরুলিয়া উচ্চভূমি এবং উত্তর-পূর্বে শুশুনিয়া উচ্চভূমিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সুবর্ণরেখা, কংসাবতী, দ্বারকেশ্বর, কোপাই, অজয়, দামোদর প্রভৃতি নদীগুলির ক্ষয় কাজের ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের এই উচ্চভূমি অঞ্চলটি সমপ্রায় ভূমিতে পরিণত হয়েছে এবং অপেক্ষাকৃত কঠিন শিলা দ্বারা গঠিত এই উচ্চভূমির বাকি অংশগুলো এখানে সেখানে টিলার মতো ছোট ছোট পাহাড়ের আকারে দঁড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাহাড় হল পুরুলিয়া জেলার অযোধ্যা,বাঘমুন্ডি ও পাঞ্চেৎ, বাঁকুড়া জেলার বিহারীনাথ ও শুশুনিয়া, বীরভূমের মামাভাগ্নে পাহাড় প্রভৃতি। অযোধ্যা পাহাড়ের গোগরাবুরু পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। গোগরাবুরু শৃঙ্গের উচ্চতা ৬৭৭ মি।


গঙ্গার ব-দ্বীপ সহ সমভূমি অঞ্চল
উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল এবং পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলকে বাদ দিলে পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ স্থানই বৈচিত্র্যহীন সমভূমি। পশ্চিমবঙ্গের এই অঞ্চলটি নদীবাহিত পলি সঞ্চয়ের ফলে গড়ে উঠেছে। ভূপ্রকৃতি ও মৃত্তিকার পার্থক্যের জন্য পশ্চিমবঙ্গের সমগ্র সমভূমি অঞ্চলকে ছয়ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন—
  • তরাই ও ডুয়ার্স অঞ্চল।
  • উত্তরের সমভূমি অঞ্চল।
  • রাঢ় অঞ্চল।
  • উপকূলের বালুকাময় সমভূমি।
  • গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চল।
  • সুন্দরবন অঞ্চল।


👉তরাই ও ডুয়ার্স অঞ্চল :-পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চলের দক্ষিণে দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমা এবং জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর ও পূর্বাংশে পার্বত্য নদীবাহিত বালি ও নুড়ি জমে তরাই অঞ্চলটির সৃষ্টি হয়েছে। এই অঞ্চলটি উত্তর থেকে দক্ষিণে ঢালু হয়ে গিয়েছে। অসংখ্য নদীখাত তরাই অঞ্চলটিকে বিভিন্ন সমান্তরাল অংশে বিভক্ত করেছে। এই অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছে তিস্তা নদীর ডানদিকের অংশ তরাই এবং বাঁদিকের অংশ ডুয়ার্স নামে পরিচিত।


👉উত্তরের সমভূমি অঞ্চল:- পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলের দক্ষিণে, তরাই ও গঙ্গার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত মালদহ, উত্তর-দিনাজপুর,দক্ষিণ-দিনাজপুরএবং কোচবিহার— এই চারটি জেলা উত্তরের সমভূমি অঞ্চলের অন্তর্গত। তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা প্রভৃতি নদীর পলি জমে এই অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে। মোটামুটি ভাবে সমতল হলেও মাঝে মাঝে এখানে সেখানে খাল-বিল এবং উঁচু-নীচু জমি চোখে পড়ে। এখানে কোনও কোনও স্থানে ৩০ মিটার পর্যন্ত উঁচু ঢিবি দেখা যায়। ভুপ্রকৃতিগত ভাবে উত্তরের সমভূমি অঞ্চলকে তাল,বরেন্দ্রভূমি ও দিয়ারা এই তিনটি অংশে ভাগ করা যায়।


👉রাঢ় অঞ্চল:- পশ্চিমের মালভূমির পূর্ব সিমা থেকে ভাগীরথী-হুগলী নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত বিস্তৃত, সামান্য ঢেউ খেলানো ও পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঢালু হয়ে যাওয়া বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চলটি রাঢ় সমভূমি নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান এবং বীরভূম জেলার পূর্বাংশ রাঢ় অঞ্চলের অন্তর্গত। পুরানো পলিমাটি দিয়ে গঠিত এই অঞ্চলটির মাটির রঙ লাল। অজয়, দামোদর, ময়ূরাক্ষী, শিলাবতী, কংসাবতী, বক্রেশ্বর প্রভৃতি হল রাঢ় অঞ্চলের প্রধান নদী। এই অঞ্চলটি কৃষিকাজে অত্যন্ত উন্নত।


👉উপকূলের বালুকাময় সমভূমি:-  মেদিনীপুর জেলার উপকুল ভাগ এই অঞ্চলের অন্তর্গত। সর্বদক্ষিণের উপকূলবর্তী তটভূমি বালুকাময়। এখানকার তটভূমির ঢাল খুবই কম । এখানে বিভিন্ন স্থানে বালিয়াড়ি দেখা যায়। তটভূমির উত্তর দিকের বালিয়াড়িগুলি সমুদ্র উপকূলের সমান্তরালভাবে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। দুটি বালিয়াড়ির মাঝের নীচু অংশে জলাভূমি দেখা যায়।


👉গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চল :- এই বদ্বীপ অঞ্চলটি পূর্বদিকে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে পশ্চিমে কান্দি মহকুমা বাদে সমগ্র মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, হাওড়া, হুগলী, কলকাতা উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা এবং বর্ধমান ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পূর্বাংশের ৫০ মিটার সমোন্নতি রেখা বরাবর বিস্তৃত। এই অঞ্চলের উত্তরে পদ্মা নদী এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর উপস্থিত। সমগ্র অঞ্চলটি সমতল হলেও উত্তর থেকে দক্ষিণে ক্রমশ ঢালু হয়ে গিয়েছে। এই অঞ্চল পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপের একটি অংশ। গঙ্গা বা পদ্মা, ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর, দ্বারকেশ্বর, রূপনারায়ণ, কাঁসাই প্রভৃতি নদনদী বাহিত পলি সঞ্চয়ের ফলে কালক্রমে সমুদ্রবক্ষ থেকে এই নতুন ভূভাগ বা বদ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে।


👉সুন্দরবন অঞ্চল :- দক্ষিণ ২৪ পরগনার দক্ষিণাংশ এই অঞ্চলের অন্তর্গত। এই অঞ্চলটি পুরোপুরিভাবে সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলের অন্তর্গত, তাই এখানে বদ্বীপ গঠনের কাজ এখনোও চলছে। সুন্দরবনের নদীগর্ভ ছাড়া সমস্ত অংশই সমতল। সমুদ্রতল থেকে এই অঞ্চলের গড় উচ্চতা মাত্র ৩-৪ মিটার হওয়ায় এর অনেকটাই সমুদ্রজলের জোয়ারে ঢেকে যায়।


➡️বদ্বীপ অঞ্চলের শ্রেণি বিভাগ:
গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চলকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়,যেমন:-
  • মুমূর্ষ বদ্বীপ।
  • পরিণত বদ্বীপ।
  • সক্রিয় বদ্বীপ।

👉মুমূর্ষ বদ্বীপ :- নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলার এই বদ্বীপ অংশে নদীগুলো গঙ্গা বা পদ্মা থেকে বিছিন্ন হয়ে মৃতপ্রায় হওয়ায় এই অঞ্চলের বদ্বীপ গঠন আর সম্ভব নয়। এখানে তাই প্রচুর বিল, জলাভূমি ও অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ দেখা যায়।


👉পরিণত বদ্বীপ :- ছোটনাগপুরের মালভূমি থেকে নদীবাহিত প্রচুর বালি, কাঁকর, পলি প্রভৃতি জমে বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া ও হুগলী জেলায় এই বদ্বীপ অঞ্চলের গঠন প্রায় শেষ হয়েছে। তাই এখানে জলাভূমির সংখ্যা অনেক কম এবং মৃত্তিকাও বেশ কঠিন।


👉সক্রিয় বদ্বীপ :- উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা এবং কলকাতা জেলার দক্ষিণে অবস্থিত সুন্দরবন অঞ্চলে নদী ও সমুদ্র বাহিত পলি দিয়ে বদ্বীপ গঠনের কাজ আজও চলছে। সমুদ্রের জোয়ারের প্রভাবে এখানকার মৃত্তিকা কিছুটা লবণাক্ত।

0 মন্তব্যসমূহ