মুদ্রাস্ফীতি বলতে কী বোঝায়? মুদ্রাস্ফীতির ধরন: (Inflation).

 মুদ্রাস্ফীতি বলতে কী বোঝায়?

আক্ষরিক অর্থে মুদ্রাস্ফীতি বলতে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধিকে বােঝানাে হয়। মুদ্রাস্ফীতি বলতে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বােঝায় যার মাধ্যমে অধিকাংশ দ্রব্যসামগ্রীর দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। 


• মুদ্রাস্ফীতির ধরন:-

  • চাহিদা জনিত মুদ্রাস্ফীতি (Demand Pull Inflation): দেশে পূর্ণ নিয়ােগ অবস্থা বলবৎ আছে, এই অবস্থায় যদি উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীর বাজারে, দ্রব্যের সামগ্রিক চাহিদা সামগ্রিক জোগানের চেয়ে বেশি হয় তাহলে জিনিসের দাম বৃদ্ধি পায়। এই ক্ষেত্রে বলা প্রয়ােজন যে যদি জিনিসের দাম একবারই বাড়ে তাহলে সেটা মুদ্রাস্ফীতি হবে না। কিন্তু যদি জিনিসের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলে, তবে তাকে চাহিদা জনিত মুদ্রাস্ফীতি বলা যাবে। 
  • ব্যয় বৃদ্ধি জনিত মুদ্রাস্ফীতি (Cost Push Inflation): যদি দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি না পায় কিন্তু যদি উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। তার ফলে যে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় সেই ধরনের মুদ্রাস্ফীতিকে ব্যয় বৃদ্ধি জনিত মুদ্রাস্ফীতি বলে। এই ক্ষেত্রে অর্থনীতি পূর্ণ। নিয়ােগ অবস্থায় রয়েছে এই অনুমানটি ধরা হয় না।

                   উদাহরণ — ধরা যাক, শ্রমের বাজারে শ্রমিকের বাড়তি চাহিদা নেই, কিন্তু ধরা যাক, শ্রমিক সংঘ বাড়তি মজুরির জন্য মালিকদের ওপর চাপ দিল। যদি শ্রমিক সংঘ মজুরি বাড়াতে সক্ষম হয় কিন্তু যদি শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতা না বাড়ে তাহলে ইউনিট পিছু উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায় ফলে দ্রব্যসামগ্রীর দামও বৃদ্ধি পাবে। শ্রমিকের মজুরি ছাড়াও অন্যান্য উপাদানের দাম বৃদ্ধি পেলেও ব্যয়। বৃদ্ধি জনিত মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে। এছাড়া যদি পেট্রোল রপ্তানিকারী দেশগুলি পেট্রোলের দাম বাড়ায়। তাহলে যে দেশটি পেট্রোল আমদানি করছে সেই দেশের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। তার প্রভাবে সেই দেশের সাধারণ দ্রব্যের দামস্তর বাড়তে পারে। 

  • মৃদু গতিবিশিষ্ট মুদ্রাস্ফীতি (Mild Inflation):- এক্ষেত্রে দামস্তরের বৃদ্ধি খুব ধীর গতিতে হয় । ভারতের মতাে দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার যদি ৪-৫ শতাংশের মধ্যে থাকে তবে তাকে মৃদু মুদ্রাস্ফীতি বলা যায়।
 
  • হাইপার ইনফ্লেশন (Hyper Inflation):- এক্ষেত্রে দামস্তর খুব দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। দাম বৃদ্ধির উপর সরকারের কোনাে নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এই ধরনের মুদ্রাস্ফীতি সাধারণত দেখা যায় না তবে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে এই ধরনের মুদ্রাস্ফীতি ঘটতে পারে। 

  • স্ট্যাগফ্লেশন (Stagflation):- এটি একটি অবস্থা যখন অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির হার অনেক বেশি থাকে এবং আর্থিক বৃদ্ধির হার অনেক কম হয় অন্যদিকে বেকারত্বের হারও বেশি থাকে। এই অবস্থা একটা অর্থনীতিকে গতিহীন করে দেয়।
  • মুক্ত মুদ্রাস্ফীতি (Open Inflation):- দামস্তর বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য যদি সরকার কোনাে ব্যবস্থা না নেয় তাহলে সেই মুদ্রাস্ফীতিকে মুক্ত মুদ্রাস্ফীতি বলে। 
  • ডিফ্লেশন (Deflation):- এটি মুদ্রাস্ফীতির বিপরীত অবস্থা। এক্ষেত্রে সমস্ত দ্রব্য ও পরিষেবার মূল্য ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে।
  • রিইনফ্লেশন (Reinflation):- অর্থনীতিতে ডিফ্রেশন এর পরিস্থিতিতে পুনরায় মুদ্রাস্ফীতি শুরু হলে একে রিইনফ্লেশন বলে।


• মুদ্রাস্ফীতির পরিমাপ-  নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলির দ্বারা মুদ্রাস্ফীতির পরিমাপ করা যায়।

  • পাইকারি দাম সূচক [Wholesale Price Index (WPI)]: মিনিস্ট্রি অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির অধীন ইকনমিক অ্যাডভাইসার (Economic Adviser) দপ্তর পাইকারি দামসূচক পরিমাপ করে। এতে পাইকারি দামের পরিবর্তন মাসিক হিসাবে পরিমাপ হয়।
  • ভােগকারীর দাম সূচক [Consumer Price Index or CPI): ভােগকারীর দামসূচক হল এমন একটি দামসূচক সংখ্যা যার মাধ্যমে দুটি ভিন্ন সময়ে ভােগকারীর ভােগ করা দ্রব্যসামগ্রীর খুচরা দাম কতটা পরিবর্তিত হয়েছে তা জানা যায়। নিম্নলিখিত বিষয়গুলি এর অন্তর্ভুক্ত হয়।

( i ) খাদ্য ও পানীয়।

( ii ) পান, মশলা প্রভৃতি।

( iii ) বস্ত্র এবং জুতাে।

( iv ) জ্বালানি ইত্যাদি । 

সাধারণত তিন ধরনের CPI হয়- সেগুলি হল 

• শিল্পের শ্রমিকদের জন্য CPI.(CPI - IW) 

• কৃষিক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য CPI. (CPI - AL)

•CPI (গ্রাম / শহর / একত্রে মিশ্রিত) 

 এগুলির মধ্যে প্রথম দুটি Labour Bureau প্রকাশ করে এবং তৃতীয়টি Central Statistics Office প্রকাশ করে। 

GDP FORIO (GDP Deflater) 

এটি হল— Nominal GDP x 100/ Real GDP.


• মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব: 

মুদ্রাস্ফীতির ফলে সামগ্রিক মূল্য বৃদ্ধি হয় অথচ টাকার মূল্য হ্রাস পায়। তখন সমাজের একাংশ লাভ করে, অপর অংশ ক্ষতির সম্মুখিন হয় এবং বাকি অংশে কোনাে প্রভাব পড়ে না। সমাজের বিভিন্ন অংশের উপর মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব নিম্নে আলােচনা করা হল-

  • ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা: মুদ্রাস্ফীতির ফলে ঋণগ্রহীতা লাভবান হয়, ঋণদাতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মূল্যবৃদ্ধির ফলে টাকার মূল্য কমে যায়, কিন্তু ঋণগ্রহীতাকে একই পরিমাণ টাকা ফেরত দেয় যা সে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। দ্রব্য ও পরিষেবার নিরিখে তাকে কম পেমেন্ট করতে হয়। কারণ যখন সে টাকা ধার নিয়েছিল, তারপর টাকার মূল্যহ্রাস পেয়েছে। সুতরাং, ঋণের বােঝা কমে যায় ও ঋণগ্রহীতার লাভ হয়। অপরদিকে, ঋণদাতা একই পরিমাণ টাকা ফেরত পেলেও প্রকৃত অর্থে সে কম টাকা পেল যেহেতু টাকার মূল্য কমে গেছে। মুদ্রাস্ফীতির ফলে ঋণগ্রহীতার থেকে ঋণদাতার কাছে মুদ্রার পুনর্বণ্টন হয়।
  • বেতনভােগী ব্যক্তি: মুদ্রাস্ফীতির ফলে সকল বেতনভােগী ব্যক্তিদের উপরেই প্রভাব পড়ে। এক্ষেত্রে টাকার মূল্যের হ্রাস হলেও তাদের বেতন সেই অনুপাতে বৃদ্ধি পায় না।
  • শ্রমিক: মুদ্রাস্ফীতির ফলে শ্রমিকরা লাভবান হতেও পারে আবার নাও পারে। কত দ্রুত তাদের পারিশ্রমিক মূলাবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে তার উপর পুরাে বিষয়টি নির্ভর করে। শ্রমিক সংগঠনের তৎপরতার। উপর বিষয়টি নির্ভর করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সময়ের ব্যবধানের জন্য শ্রমিকরা ক্ষতির সম্মুখীনই হয়, কারণ যতদিনে তাদের পারিশ্রমিক বৃদ্ধি পায়, ততদিনে Cost of living index- ও বেড়ে যায়। 
  • স্থায়ী আয় বিশিষ্ট ব্যক্তি: পেনশন, বেকারভাতা, বেকারত্ব বিমা,সামাজিক সুরক্ষা, সুদ, বাড়িভাড়া ইত্যাদি যারা পায় তারা হলেন স্থায়ী আয় বিশিষ্ট ব্যক্তি। ডিবেঞ্চার বা অন্যান্য সিকিউরিটিস যারা ক্রয় করেন এবং যারা ডিপােজিট গচ্ছিত রাখেন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে তারাও মাসের শেষে নির্দিষ্ট টাকা সুদ হিসেবে পান। এরা প্রত্যেকেই মুদ্রাস্ফীতির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন কারণ এদের আয় নির্দিষ্ট অথচ মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে টাকার মূল্য কমে যায়।
  • বিনিয়ােগকারী: যে সমস্ত ব্যক্তিরা শেয়ার ক্রয় করেন, মুদ্রাস্ফীতির ফলে তাদের লাভ হয়। মূল্যবৃদ্ধি হলে ব্যবসার প্রসার ঘটে, কোম্পানির লাভ হয় ফলে তারা বেশি ডিভিডেন্ট পেতে পারেন। ডিভিডেন্টের হার মূল্যবৃদ্ধির হারের থেকেও বেশি। কিন্তু যারা বন্ড, ডিবেঞ্চার, G - sec ইত্যাদি ক্রয় করেন তাদের ক্ষতি হয় কারণ তারা এগুলির থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আয় করেন, মূল্যবৃদ্ধির ফলে যার কোনাে পরিবর্তন হয় না, অপরদিকে ক্রয় ক্ষমতাও হ্রাস পায়।
  • ব্যবসায়ী: মূল্যবৃদ্ধির সময় ব্যবসায়ীরা লাভবান হয়।     উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে যখন মূল্যবৃদ্ধি হয়, স্টকের দামও তখন বেড়ে যায়। সুতরাং, যখন তারা সেই জিনিসগুলাে বিক্রি করেন তখন ভালই লাভ হয়।
  • কৃষিজীবী: কৃষিজীবী মূলত তিন প্রকার- 

( 1 ) জমিদার।

( 2 ) জমির স্বত্বাধিকারী।

( 3 ) জমিহীন কৃষক। 

জমিদাররা মুদ্রাস্ফীতির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন, কারণ তারা নির্দিষ্ট ভাড়া পান। অপরদিকে জমির স্বত্বাধিকারীরা যেহেতু নিজেরাই চাষাবাদ করেন, সেক্ষেত্রে তাদের লাভ হয়। কিন্তু কৃষকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারণ উৎপাদন ব্যয় অপেক্ষা দ্রব্যের মূল্য বেশি হয়।

  • সরকার: এক্ষেত্রে সরকার হল ঋণগ্রহীতা ও পরিবার হল ঋণদাতা। সুতরাং মুদ্রাস্ফীতির ফলে সরকারের লাভ হয়। মুদ্রাস্ফীতি হলে সরকার পরিষেবা কর কমিয়ে দেয়। বস্তুত, মুদ্রাস্ফীতির ফলে করের প্রকৃত মূল্য কমে যায়। সরকার সম্পদের পুনর্বণ্টনের দ্বারা লাভবান হয়। উচ্চ আয় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সাধারণত করদাতা হয়। তারা সরকারের ঋণদাতাও হয় কারণ তারা সরকারি বন্ড ক্রয় করেন। ঋণদাতা হিসেবে তাদের সম্পদের প্রকৃত মূল্য হ্রাস পায় ও প্রকৃত দায়ও হ্রাস পায়। কিন্তু কত মাত্রায় লাভ বা ক্ষতি হল তা পরিমাপ করা দুষ্কর। মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আয় বৃদ্ধি হলে, সরকার কর হিসেবে বেশি রাজস্ব সংগ্রহ করে।
  • উৎপাদনের উপর প্রভাব: মূল্যবৃদ্ধি হলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। বেশি লাভের আশায় তারা উৎপাদন বৃদ্ধি করবে। ফলস্বরূপ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।আরও উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, আয়ও বাড়বে। কিন্তু পূর্ণ কর্মসংস্থান পর্যন্তই এটি সম্ভব। এর বেশি বিনিয়ােগ করলে অর্থনীতির উপর মুদ্রাস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে কারণ যেহেতু পূর্ণ সম্পদ ব্যবহৃত হয়েছে, তাই উৎপাদন হার অপেক্ষা মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়বে। সুতরাং পূর্ণ সম্পদের পর মুদ্রাস্ফীতি উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের সুযােগের  উপরবিরূপ প্রভাব ফেলে। অনিশ্চয়তার আশঙ্কাও অনেকসময় উৎপাদনের। উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
  • কর্মসংস্থানের উপর প্রভাব: বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতির সম্পর্ক বিপরীত। উইলিয়াম ফিলিপসের তত্ত্ব অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতির হার যত বেশি হয় বেকারত্বের পরিমাণ তত কম হয়। তবে অধ্যাপক ফিলিপসের তত্বটি সল্প মেয়াদি। এটি স্ট্যাগফ্রেশনের বিষয়টি বিশ্লেষণ করে না যখন ও বেকারত্বের হার দুটোই অনেক বেশি থাকে।
  • সম্পদ: মুদ্রাস্ফীতির ফলে বিবিধ সম্পদের বৃদ্ধি ঘটে যেহেতু অধিক লাভের আশায় উৎপাদকরা প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের পাশাপাশি অপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যও উৎপাদন করে।
  • আর্থিক লেনদেন: মুদ্রাস্ফীতির ফলে আর্থিক লেনদেনের পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়। ভবিষ্যতের জন্য উৎপাদকরা‘লিকুইড’ ক্যাশ নিজেদের কাছে গচ্ছিত রাখেন। তাঁরা লিকুইড ক্যাশকে স্টকেরূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে বেশি যত্নবান হন। এর ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু সম্পদও নষ্ট হয়।
  • দ্রব্যের গুণগত মান: মুদ্রাস্ফীতির ফলে দ্রব্যের গুণগত মান হ্রাস পায়, কারণ অধিক লাভের আশায় উৎপাদকরা নিম্নমানের দ্রব্য প্রস্তুত করেন। 
  • ব্ল্যাকমার্কেট: মূল্যবৃদ্ধির ফলে উৎপাদকরা প্রায়শই স্টক মজুদ করে রাখে। ফলস্বরূপ, বাজারে কৃত্রিম ঘাটতির সৃষ্টি হয়। তখন উৎপাদকরা ব্ল্যাকমার্কেটে চড়া দামে জিনিসগুলি বিক্রয় করে। অপরদিকে, ব্ল্যাকমার্কেটও মুদ্রাস্ফীতির জন্য অনেকাংশে দায়ী।
  • সেভিংসের উপর প্রভাব: যখন মূল্যবৃদ্ধি হয়, টাকা জমানাের প্রবৃত্তিও কমে যায়, কারণ দ্রব্য ও পরিষেবারও মূল্যবৃদ্ধি হয়। সেভিংসে হ্রাস বিনিয়ােগ ও মূলধনের জোগানকেও কমিয়ে দেয়। 
  • বিদেশি মূলধন: মুদ্রাস্ফীতি বিদেশি মূলধনের প্রবাহকে রােধ করে , কারণ দ্রব্য ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি হওয়ায় বিদেশি বিনিয়ােগের ক্ষেত্রে লাভের পরিমাণ কমে যায় । প্রসঙ্গত, FDI GDP- র উপর উল্লেখযােগ্য প্রভাব বিস্তার করে।
  • স্পেকুলেশন (ফাটকা): দ্রুত লাভের আশায় যে সকল উৎপাদকরা স্পেকুলেশনের সঙ্গে জড়িত, মূল্যবৃদ্ধির ফলে তারা অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয়। উৎপাদনশীল কাজে নিযুক্ত হওয়ার পরিবর্তে তারা বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল সংক্রান্ত বিষয়ে স্পেকুলেশন করে। প্রসঙ্গত, স্পেকুলেশন মুদ্রাস্ফীতির জন্য দায়ী।ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের উপর প্রভাব: 

যখন বিদেশের তুলনায় দেশের বাজারে অধিক মূল্যবৃদ্ধি হয়, তখন বিদেশি দ্রব্যগুলি তুলনামূলক সস্তা হওয়ায়, রপ্তানি অপেক্ষা আমদানি বৃদ্ধি পায়, ফলে ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

  •  আর্থিক ব্যবস্থা:  Hyperinflation- এর সময় টাকার মূল্য যদি সারাদিনে একাধিকবার হ্রাস পায় তাহলে আর্থিক ব্যবস্থা ধসে পড়তে পারে। 
  • সামাজিক প্রভাব: মুদ্রাস্ফীতির ফলে Cost of living বেড়ে যায়, আয় বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, সমাজে অস্থির অবস্থার সৃষ্টি হয়। উৎপাদকরা বেশি লাভের আশায় অনৈতিক উপায় অবলম্বন করে, ফলে দুর্নীতির বীজ বপন করা হয়। 
  • অর্থনৈতিক প্রভাব: মুদ্রাস্ফীতির ফলে সরকারের বিরুদ্ধে জনরােষ গড়ে ওঠে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে সরকারের পতন অনিবার্য।


• মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উপায়: 

মুদ্রাস্ফীতি সহজে দমন করা যায় না। মুদ্রাস্ফীতি দমন করার সাধারণ উপায় হল অর্থের আগমন বা আর্থিক ব্যবস্থায় লিকুইডিটি হ্রাস করা। মুদ্রাস্ফীতি দমন করার উপায়গুলি হল – 

  • Monetary Measure কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ভূমিকা: 

কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির ক্ষেত্রে ঋণের উপর সুদ বৃদ্ধি করে। এটি অর্থ সরবরাহকে নিয়ন্ত্রণ করে, ফলে মুদ্রাস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসে। যখন ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার বৃদ্ধি হয়, জনগণের টাকা জমানাের প্রবৃত্তি বেড়ে যায় ও বিনিয়ােগের ইচ্ছা কমে যায়। 

  • Fiscal Measure: রাজস্ব নীতি অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতি দমনে সরকার ব্যক্তিগত ব্যয় বা সরকারি ব্যয় হ্রাস করে। ব্যক্তিগত ব্যবসায় কর ধার্য করার মাধ্যমে সরকার ব্যক্তিগত ব্যয় হ্রাস করে। সমাজকল্যাণের স্বার্থে সরকার সাধারণত ব্যয় হ্রাস করতে পারে না, তখন একমাত্র উপায় ব্যক্তিগত ব্যয় হ্রাস করা। কর বৃদ্ধি হলে সাধারণ মানুষ তাদের ব্যয় হ্রাস করবে ফলে অর্থনীতিতে অর্থ সরবরাহ কমবে। 
  • Price Control: এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি স্বল্পকালের জন্য দমিত হয়, কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদি ফলপ্রসূ ব্যবস্থা নয়। একে 'Suppressed Inflation ' বলা হয়। মুদ্রাস্ফীতির কারণ সঠিকভাবে নির্ধারণ না করতে পারলে মুদ্রাস্ফীতি দমন করা সম্ভব নয়। 
  • Inflation Targeting: এই পদ্ধতিটি আর্থিক নীতির একটি বিশেষ ব্যবস্থা যারা দ্বারা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।

Monetary Policy Framework Agreement: 

২০১৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও কেন্দ্রীয় সরকার Monetary Policy Framework সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তি অনুযায়ী আর্থিক নীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মূল্য স্থায়ীত্ব অথচ এক্ষেত্রে বৃদ্ধি ব্যাহত হয় না। এই Frameowork- টি পরিচালনা করবে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। 

RBI নিয়মিত Monetary Policy Target সংক্রান্ত ডকুমেন্ট প্রকাশ করে। প্রতি ছ - মাস অন্তর RBI মুদ্রাস্ফীতির কারণ ও পরবর্তী ৬-১৮ মাসে মুদ্রাস্ফীতির মাত্রা সম্পর্কেও তথ্য প্রকাশ করে। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের এপ্রিল মাস থেকে RBI আর্থিক নীতির নির্দেশক হিসেবে CPI- কে ব্যবহার করছে।

• Phillips Curve:

বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি সম্পর্ক বিপরীত। উইলিয়াম ফিলিপস তাঁর ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত 'Relation between Unemployment and the rate of change of money wage rates in the United Kingdom , ১৮৬১-১৯৫৭ " রিপাের্টে এই ধারণার প্রথম প্রবর্তন করেন। এই মতবাদটি প্রমানিত সত্য। এই তত্ত্ব অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতির হার যত বেশি, বেকারত্বের হার তত কম। সুতরাং অধিক কর্মসংস্থান তখনই সম্ভব যখন অর্থনীতিতে অধিক মাত্রায় মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করে। ফিলিপস কার্ভের মাধ্যমে বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি সংক্রান্ত নীতি গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ফিলিপস কার্ভের তত্ত্বটির বিশ্লেষণ স্বল্পমেয়াদি। এটি স্ট্যাগফ্লেশনের বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে পারে না যখন মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের হার দু’টোই অনেক বেশি থাকে। 

  • মুদ্রাস্ফীতির ফলে সাধারণ মূল্য স্তর বৃদ্ধি পায় ফলে টাকার মূল্য কমে যায়, অর্থনীতিতে অর্থের জোগান বেড়ে যায়, সুদের হাড় বেড়ে যায়, বিনিয়ােগ ব্যাহত হয়, টাকার অবমূল্যায়ন হয়, আমদানি ব্যয় সাপেক্ষ হয়ে ওঠে। 
  • সাধারণ মূল্য স্তর হ্রাস ডিফ্লেশন দ্বারা চিহ্নিত হয় যা মূলত সরকারি ব্যয় হ্রাসের ফলে ঘটে।
  • Producer Price Index : উৎপাদকের নিরিখে মূল্যের পরিবর্তন এই Index দ্বারা সূচিত হয়। 
  • শক্তি ও খাদ্যদ্রব্য ব্যতীত মুদ্রাস্ফীতির পরিমাপ হল Core Inflation.

0 মন্তব্যসমূহ