স্বত্ববিলােপ নীতি ও স্বত্ববিলােপ নীতির প্রয়োগ:


ভারতের ব্রিটিশ বড়ােলাট লর্ড ডালহৌসি যেসব নীতি অবলম্বন করে এদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটান সেগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য হল 'স্বত্ববিলােপ নীতি' (Doctrine of lapse)। স্বত্ববিলোপ নীতি হল, ইংরেজদের আশ্রিত কোনো রাজ্যের উত্তরাধিকারী না থাকলে সে রাজ্যের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হবে এবং দত্তকপুত্রের উত্তরাধিকার স্বীকার করা হবে না।

ডালহৌসী স্বত্ববিলোপ নীতি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করে রাজ্য বিস্তারে উদ্যোগী হন। দত্তক প্রথা প্রয়োগ করার ব্যাপারে, তিনি দেশীয় রাজ্যগুলিকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করেন,
যথা –
  • কোম্পানির সৃষ্ট দেশীয় রাজ্য।
  • কোম্পানির অধীনে করদ রাজ্য।
  • স্বাধীন দেশীয় রাজ্য।

ডালহৌসী এক নির্দেশনামা ঘোষণা করে প্রথম শ্রেণীর দেশীয় রাজ্যগুলিকে দত্তক-প্রথা নিষিদ্ধ করেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর রাজ্যে কোম্পানির অনুমতি ছাড়া দত্তক গ্রহণ করা নিষিদ্ধ করেন এবং স্বাধীন দেশীয় রাজ্যগুলিতে দত্তক-প্রথা বহাল রাখেন। ডালহৌসীর এই নির্দেশনামা 'স্বত্ববিলোপ নীতি' (Doctrine of lapse) নামে খ্যাত।

স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ:
  • স্বত্ববিলোপ নীতি কঠোরভাবে প্রয়োগ করে ডালহৌসী।
  • প্রথমেই ব্রিটিশ প্রভাবাধীন সাতারা দখল করেন (১৮৪৮ খ্রিঃ)।
  • এরপর ১৮৫৩ সালে নাগপুরের রাজা অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে তাঁর রাজ্যটি গ্রাস করা হয়, এক্ষেত্রে ডালহৌসীর যুক্তি ছিল এই যে, নাগপুর রাজ্যটি ইংরেজরাই সৃষ্টি করেছিল।
  • ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধর রাও-এর প্রয়াণ হলে ডালহৌসী তাঁর দত্তক পুত্রকে মেনে নিতে রাজি হলেন না এবং ঝাঁসির রানির মতামতকে উপেক্ষা করেই এই রাজ্যটি দখল করা হল।
  • এছাড়া ভগৎপুর, করৌলী, সম্বলপুর, উদয়পুর, জৈৎপুর, বাগৎ প্রভৃতি রাজ্যগুলি একই কারণে গ্রাস করা হয়, যদিও উদয়পুর কোম্পানির সৃষ্টি দেশীয় রাজ্য ছিল না।

স্বত্ববিলোপ নীতির সমালোচনা:
এই নীতি সমালোচনার উর্ধে ছিল না। সমকালীন আমলাতন্ত্র ও পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকরা এই নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। স্যার হেনরি রাসেল, ম্যালকম, এলফিনস্টোন সকলেই ডালহৌসির বিরুদ্ধে তিক্ত মতামত প্রকাশ করেছেন।
যেমন–
দেশীয় রাজ্যের পার্থক্য মানা হয়নি:
এই নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্রিটিশের দ্বারা সৃষ্ট রাজ্য ও ব্রিটিশ আশ্রিত করদ বা মিত্র রাজ্যের মধ্যে যে পার্থক্য কর হয়েছিল, বাস্তবে তা মানা হয় নি। উদয়পুর ব্রিটিশ-সৃষ্ট রাজ্য ছিল না। অপরদিকে করৌলি ছিল আশ্রিত রাজ্য, কিন্তু উভয়ক্ষেত্রেই এই নীতি প্রযুক্ত হয়।

সাতারা ও নাগপুর দখলের প্রকৃত কারণ:
রাজার পুত্রসন্তান না থাকার জন্য সাতারা ও নাগপুর রাজ্য দুটি ডালহৌসি দখল করেন। কিন্তু এর প্রকৃত কারণ ছিল এই যে- বোম্বাই-মাদ্রাজ ও মাদ্রাজ-কলকাতা যাতায়াতের পথে অবস্থিত ছিল।

হিন্দু সমাজে ক্ষোভের সৃষ্টি:
হিন্দুদের চিরাচরিত ধর্মীয় সংস্কার ও ঐতিহ্য দ্বারা দত্তক গ্রহণ স্বীকৃত ছিল। হিন্দুরা মনে করত যে, পুত্র না থাকলে পিতৃপুরুষদের শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া সম্পন্ন হয় না। বলা বাহুল্য, ভালহৌসির কার্যকলাপ হিন্দু সমাজকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।

    ঐতিহাসিক রাসেল বলেন যে, একটি দেশীয় রাজ্যের অবলুপ্তির অর্থ হল কফিনে একটি পেরেক পোঁতা। ঐতিহাসিক এলফিনস্টোন -এর মতে এক একটি রাজ্য ও প্রজাবৃদ্ধির অর্থ হল ভারতে আমাদের পতন ত্বরান্বিত হওয়া।

0 মন্তব্যসমূহ