হজরত মহম্মদ ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন ও ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে দেহত্যাগ করেন। হজরত মহম্মদ মারা যাওয়ার পর একশো বছরের মধ্যে আরবরা পারস্য দখল করে ভারতের দিকে অগ্রসর হয়। ভারতে প্রথম মুসলিম আক্রমণ শুরু হয় সিন্ধুতে। সে সময় সিন্ধুর রাজা ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মী দাহির। ইরাক ও খোরাসানের শাসক ছিলেন হজ্জাজ। হজ্জাজ ভারতে আরব বা তুর্কী আক্রমণের সূচনা করেন। তিনি পরপর দুটি অভিযান সিন্ধুতে প্রেরণ করেন। কিন্তু এই দুটি অভিযানই ব্যর্থ হয়। তখন ৭১১ খ্রিস্টাব্দে হজ্জাজ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা মহম্মদ বিন কাশিমকে তৃতীয় অভিযানের সেনানায়ক করে পাঠান। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ বিন কাশিম সিন্ধুর এক বন্দর দেবল দখল করে একের পর এক সিন্ধুর নগরগুলি অধিকার করেন। দেশের এই সংকটকালে রাজা দাহিরের হাতে নির্যাতিত জাঠ, মেড়, ও বৌদ্ধরা দলে দলে স্বদেশের বিরুদ্ধে শত্রুপক্ষে যোগ দেয়। পুরস্কারের লোভে অনেক হিন্দু সামন্তরাও আরবদের সাহায্য করে। নিরুন দখল করে মহম্মদ বিন-কাশিম সিন্ধু আক্রমণ করলে সেই যুদ্ধে দাহির পরাজিত ও নিহত হয়। এরপর মহম্মদ বিন কাশিম মুলতান আক্রমণ করলে সেখানকার বণিক ও শিল্পীরা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। আরবদের এই সিন্ধু বিজয় ভারতের ইতিহাসের উপর কোনো ছায়া বিস্তার করতে পারেনি। আরবরাই ভারতীয় সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারতীয়দের কাছ থেকে সঙ্গীত, জ্যোতিষ, চিত্রকলা, শাসনপ্রণালী, প্রভৃতি বিষয় সাদরে গ্রহণ করেছিল। আরবদের সিন্ধু জয়ের ফলে ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলির বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে।
আরবদের সিন্ধু অভিযানের কারণ:
আরবদের সিন্ধু অভিযানের পশ্চাতে বিবিধ কারণ নিহিত ছিল। এ বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। তাদের বর্ণনার মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ উভয় প্রকার কারণ লক্ষ করা যায়।
আরবদের সিন্ধু অভিযানের পরোক্ষ কারণসমূহ:
অর্থনৈতিক কারণ: অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, বণিক জাতি আরবীয়রা ইসলামের নবশক্তিতে বলিয়ান হয়ে তাদের ব্যবসায়ের সম্প্রসারণের জন্য সুদীর্ঘকালের পরিচিত ভারতের প্রতি নজর দেয়। অনেকে আবার ঐশ্বর্যশালী ভারতের ধনসম্পদ হস্তগত করার জন্য মরুবাসীরা ভারতে এ অভিযান পরিচালনা করে বলে মনে করেন। সুতরাং রাজনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক কারণই এর পেছনে অধিকতর ক্রিয়াশীল ছিল বলে তাদের ধারণা।
রাজনৈতিক কারণ: কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, সাম্রাজ্যবাদী মুসলিম শাসক শ্রেণীর সাম্রাজ্য বিস্তারের ধারাবাহিকতায় এ অভিযান প্রেরিত হয়। সূচনালগ্ন হতেই ধর্মভিত্তিক আরবীয় এ রাষ্ট্রটি দ্রুতবেগে চারিদিকে সাম্রাজ্য বিস্তার করে সম্প্রসারিত হতে থাকে। ইতােমধ্যে প্রায় সমগ্র উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম এশিয়াসহ প্রায় সমগ্র মধ্য এশিয়া দখল করে তারা ভারতের সীমান্ত পর্যন্ত এসে পৌঁছে যায়। সুতরাং, তারই ধারাবাহিকতায় ভারতের ন্যায় সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র দখল করে সাম্রাজ্যকে আরাে সম্প্রসারিত করার ইচ্ছা পােষণ করা অস্বাভাবিক নয়।
ধর্মীয় কারণ: ধর্ম প্রচারও এর পেছনে অন্যতম কারণ ছিল বলে কোন কোন ঐতিহাসিক মত প্রকাশ করেছেন। মূলত আরব কেন্দ্রীক মুসলমানদের রাষ্ট্র ইতামধ্যেই বিশ্বের শক্তিশালী এক রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে আফ্রিকা ও ইউরােপে একাধিক এলাকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্রটি পূর্ব দিকেও তার বিস্তার অব্যাহত রাখে। বিজেতারা ইসলামী শক্তিতে বলীয়ান ছিল এবং নতুন নতুন দেশ জয় করে ইসলাম প্রচার করতে থাকে। সীমান্তের অমুসলিম রাষ্ট্র ভারতেও ইসলাম প্রচার তাদের কাছে আবশ্যক হয়ে পড়ে।
প্রতিশোধ স্পৃহা: আরবদের পারস্য অভিযানকালে পারস্যদের দিয়ে সিন্ধুর রাজা দাহির সাহায্য করেন। তার প্রতিশােধ নেয়ার স্পৃহাও এই অভিযানকে ত্বরান্বিত করে।
শিয়া বিদ্রোহীদের সিন্ধুতে আশ্রয় লাভ: হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের কঠিন মনে কতিপয় শিয়া বিদ্রোহী আরব সিন্ধুর রাজা দাহিরের নিকট আশ্রয় লাভ করায় তাদের প্রত্যার্পণ দাবী করে হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ। কিন্তু রাজা দাহির তা প্রত্যাখ্যান করায় হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ ক্ষুব্ধ হন এবং রাজা দাহিরকে শাস্তি দেবার জন্য দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন।
হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের উচ্চাকাঙ্ক্ষা: হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের উচ্ছাকাঙ্ক্ষা এ অভিযানের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল। পশ্চিম রণাঙ্গনের বীর সেনানী মূসা ও তারিকের সাফল্যে পূর্বাঞ্চলীয় শাসনকর্তা হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ উৎসাহী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেন। তার রাজ্য বিস্তারের এ উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার ইচ্ছাও এর পেছনে অন্যতম ভূমিকা রাখে।
ভারতে রাজনৈতিক অনৈক্য: ভারতের তদকালীন ক্ষয়িষ্ণু ও অনৈক্যপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থাও মুসলমানদের এ অভিযানকে উৎসাহিত করে। এসময় ভারত যেমন অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল তেমনি তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলও বিরাজমান ছিল। কোন বিদেশী আক্রমণকারীকে একক বা সম্মিলিতভাবে প্রতিরােধ করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। এর পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে এ অভিযান প্রেরিত হয়।
সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: পারস্য বিজয়ের ফলশ্রুতিতে মুসলিম সাম্রাজ্য সিন্ধুর রাজা দাহিরের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় তিনি সন্দিহান হয়ে পড়েন। অন্যদিকে রাজা দাহিরের মুসলিম বিদ্বেষী ভূমিকায় মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমান্তও হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। তাই সীমান্তের নিরাপত্তার জন্য সীমান্তবর্তী রাজা দাহিরের ধ্বংস সাধন করা মুসলমানদের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে।
আরবদের সিন্ধু অভিযানের প্রত্যক্ষ কারণ:
উপযুক্ত কারণসমূহ এ অভিযানের পেছনে ক্রিয়াশলী থাকলেও তা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। দীর্ঘদিনের এ কারণসমূহ আরবদেরকে মানসিভাবে প্রস্তুত করে, সন্দেহ নেই। ঠিক তখন এমন একটি সমস্যার সৃষ্টি হয় যা তাৎক্ষণিকভাবে মুসলমানদেরকে ভারত আক্রমণে বাধ্য করে। এ কারণটিকে ঐতিহাসিকরা প্রত্যক্ষ কারণ বলে অভিহিত করেছেন। সিংহলে ব্যবসা উপলক্ষে অবস্থানরত কয়েকজন আরব বণিকের মৃত্যু হলে সিংহলরাজ মৃত বণিকদের পরিবার-পরিজন ও হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের জন্য কিছু উপঢৌকন ৮টি জাহাজ যােগে বসরায় প্রেরণ করেন। কিন্তু জাহাজগুলো সিন্ধু উপকুলে দেবল বন্দরে পৌঁছলে কিছু সংখ্যক জলদস্যু কর্তৃক তা লুণ্ঠিত ও মৃত বণিকদের পরিবার-পরিজন বন্দি হয়। হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ উক্ত জলদস্যুদের শাস্তি প্রদান এবং লুণ্ঠিত মালামালসহ আটককৃত লােকদের প্রত্যার্পণ দাবী করে রাজা দাহিরের নিকট পত্র লেখেন। কিন্তু দাহির তা করতে অস্বীকার করলে সেগুলো উদ্ধার ও রাজা দাহিরকে সমূচিত শাস্তি দিতে অভিযানের আশু প্রয়ােজন দেখা দেয়। ফলে মুসলিম শাসনকর্তা আর কালবিলম্ব না করে দাহিরের বিরুদ্ধে সমর অভিযান প্রেরণ করেন।
আরবদের সিন্ধু অভিযান:
হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ ছিলেন একজন দুর্ধর্ষ প্রকৃতির শাসনকর্তা। তিনি দাহিরকে ধ্বংস করার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠেন এবং সেনাপতি ওবায়দুল্লাহর নেতৃত্বে একটি অভিযান প্রেরণ করেন। কিন্তু যুদ্ধে ওবায়দুল্লাহ পরাজিত ও নিহত হন। এরপর তিনি সেনাপতি বুদাইনের নেতৃত্বে আর একটি অভিযান পাঠান। কিন্তু বুদাইনেরও একই পরিণতি হয়। পরপর দুটি অভিযান ব্যর্থ হলেও হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ হতােদ্দম হননি। তিনি নিজ ভ্রাতুস্পুত্র ও জামাতা তরুণ ও সাহসী সেনাপতি মুহম্মদ-বিন-কাসিমের উপর তৃতীয় অভিযানের দায়িত্ব অর্পণ করেন। কাসিম বেলুচিস্তানের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে দেবল, নিরুন, সিওয়ান, সিসাম প্রভৃতি একের পর এক শহর জয় করে অগ্রসর হন এবং রাওয়ার নামক স্থানে ৭১১ খ্রিস্টাব্দে রাজা দাহিরের মুখােমুখি হন। ইতােমধ্যে ব্রাহ্মণ নরপতি রাজা দাহিরের হাতে নির্যাতিত জাঠ-মেঠগণ মুহাম্মদ বিন-কাসিমের পক্ষাবলম্বন করে মুসলিম বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করে। শুধু তাই নয়, তারা রাজা দাহিরের দুর্বলতাসমূহও মুসলিম সেনাপতিকে অবহিত করে। তা সত্ত্বেও রাজা দাহির বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পরাজিত ও নিহত হন (২০ জুন, ৭১২ খ্রিস্টাব্দে)। রাজা দাহিরের মৃত্যুর পর তার বিধবা পত্নী রাণীবাঈ এবং পুত্র জয়সিংহ ১৫০০০ সৈন্য নিয়ে আবার প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তােলেন। কিন্তু টিকতে না পেরে অন্যান্য রমণীদের নিয়ে সম্ভ্রম রক্ষার জন্য রাণীবাঈ আগুনে ঝাপ দিয়ে আত্মাহুতি দেন। পুত্র জয়সিংহ ব্রাহ্মণবাদে আশ্রয় নেন। এভাবে দাহিরের পতন হয় এবং রাওয়ার দুর্গ সহজেই অধিকৃত হয়।
রাওয়ার অধিকারের পর মুহম্মদ-বিন-কাসিম জয় সিংহের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তাকে পরাজিত করে ব্রাহ্মণবাদ দখল করেন। সুরজ দেবী ও পরমল দেবী নামক দাহিরের দুই কন্যাকে বন্দী করে তিনি খলিফার নিকট প্রেরণ করেন। এরপর তিনি সিন্ধুর রাজধানী আলাের দখল করেন। সিন্ধুর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে মুহম্মদ-বিন-কাসিম মুলতান আক্রমণ করেন। আক্রমণ প্রতিরােধ করতে না পেরে সেখানকার শাসনকর্তা আত্মসমর্পণ করেন। মুহম্মদ আরাে অগ্রসর হয়ে আক্রমণ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। কিন্তু এ সময় খলিফা তাকে জরুরী ভিত্তিতে রাজধানীতে ডেকে পাঠালে কনৌজ অভিযান পরিত্যক্ত হয়। কথিত আছে, দাহিরের ধৃত কন্যাদ্বয় মুহম্মদ বিন কাসিমের বিরুদ্ধে খলিফার নিকট সম্ভ্রমহানীর মিথ্যা অভিযােগ করলে খলিফা তাকে রাজধানীতে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেন। অবশ্য ঐতিহাসিক বালাজুরী ও ইবনে খালদুন এ কাহিনীকে মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের মতে, খলিফা ওয়ালিদের পর এ সময় সুলায়মান খলিফা হলে রাজনৈতিক কারণে তিনি মুহম্মদ-বিন-কাসিমকে কারারুদ্ধ করেন এবং অমানুষিক নির্যাতনের ফলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। মুহম্মদ-বিন-কাসিমের মৃত্যুতে এই অঞ্চলে যােগ্য নেতৃত্বের অভাবে মুসলমানদের কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে। পরবর্তী খলিফাগণ সাম্রাজ্য বিস্তারে তেমন আগ্রহী না হওয়ায় সামরিক তৎপরতাও স্তিমিত হয়ে পড়ে। ফলে এ সময় আর কোন অভিযান পরিচালিত হয়নি।
আরবদের সিন্ধু বিজয়:
মুসলমানদের দীর্ঘ লালিত ভারত বিজয়ের স্বপ্ন মুহম্মদ-বিন-কাসিম পূরণ করেন। এ বিজয় ইসলাম ধর্মে উদ্বুদ্ধ আরবীয় সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির ধারাবাহিকতায় হলেও এর সাফল্যের পেছনে স্থানীয় কিছু কারণও নিহিত ছিল। আরবদের এ বিজয়ের সাফল্যের কারণ মূলত দুটি –
- মুসলিম বাহিনীর দক্ষতা।
- ভারতীয়দের দুর্বলতা।
মুসলমানদের একের পর এক অঞ্চল জয় এই যুগটি ছিল মুসলমানদের বিজয়ের যুগ। তখন মুসলমানদের জয়জয়কার অবস্থা। ইসলামী শক্তিতে বলিয়ান মুসলিম বাহিনী এসময় বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বি শক্তিতে পরিণত হয়ে একের পর এক দেশ ও জনপদ পদানত করে এগিয়ে যায়। ইতঃপূর্বে তারা ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা পর্যন্ত সাম্রাজ্যভুক্ত করে। ভারতীয়দের মাঝে তখন এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, খুব শীঘই তাদের দেশ আরবীয়দের দখলে চলে যাবে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-বিগ্রহ করা নিরর্থক। তাই অযথা যুদ্ধের চেয়ে তারা আত্মরক্ষায় মনােযোগী হয়। সুতরাং তখনকার মুসলমানদের সামগ্রিক অবস্থা এ অভিযানকে সফল করতে বাড়তি শক্তি যােগায়।
ভারতীয়দের দুর্বলতা:
আরবীয়দের সাফল্যে ভারতীয়দের দুর্বলতাও অনেকাংশে দায়ী ছিল। রাজা দাহিরের দুঃশাসন ও তার প্রতিক্রিয়া এক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। দাহিরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বহু বৌদ্ধ, হিন্দু, জাঠ, মেঠ প্রভৃতি গােষ্ঠী অনেকদিন ধরেই দাহিরের পতন কামনা করছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতের এক বিরাট সংখ্যক নিম্নবর্ণের হিন্দু নিজ রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। যুদ্ধ বিগ্রহে অংশগ্রহণ করা তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। কেবল উচ্চ বর্ণের হিন্দুরাই সৈনিক বৃত্তি গ্রহণ করতে পারত। ফলে এই অধিক সংখ্যক নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সহযােগিতা রাজা দাহির পাননি। বরঞ্চ তারা মুহম্মদ-বিন-কাসিমের আগমনে তাদের মুক্তির পথ খুঁজে পায়। এজন্য মুসলিম বাহিনীকে তারা সর্বাত্মক সহযােগিতা করে। ভারতীয়দের রাজনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব ও কোন্দল নিজেদেরকে কেবল বিভাজনই করেনি, চরমভাবে দুর্বল করে ফেলে। রাজা দাহির মুসলমানদের আক্রমণ প্রতিরােধে স্বজাতিকে একত্রিত করতে পারেননি। তাছাড়া রাজা দাহিরের ব্যক্তিগত অদক্ষতা, চারিত্রিক দুর্বলতা, প্রাচীন পদ্ধতির সেনাবাহিনী, সামন্তনীতির ব্যর্থতা আরবীয়দের সহায়ক হয়। উপরন্তু, দাহিরের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মচারী ও অভিজাত দাহিরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। রাজা দাহিরের অর্থনৈতিক দৈন্যতাও তাকে সামরিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে দুর্বল করে রাখে। এ সকল কারণে আরবীয়রা অতি সহজেই সিন্ধু ও তার আশেপাশের অনেক এলাকা দখল করে বিজয় পতাকা উড়াতে সক্ষম হয়।
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল:
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ করা যায়। ঐতিহাসিকদের অনেকে এ অভিযানকে নিষ্ফল অভিযান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ এ অভিযানের পর আরবরা ভারতে কোন স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের শাসনের বিলুপ্তি ঘটে। অনেকে এ অভিযানকে ফলাফল শূন্য কোন আকস্মিক ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। লেনপুলের মতে, 'আরবরা সিন্ধু জয় করেছিল, কিন্তু এই বিজয় ভারতের ইতিহাসে কেবল একটি এপিসোড ছিল, আর এখানে কোন ফলাফল ছাড়াই এখানে ইসলামের বিজয় হয়েছিল।' কিন্তু অনেকে আবার এ অভিযানকে তাৎপর্যপুর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর ফলাফলগুলো হলো –
রাজনৈতিক ফলাফল: প্রত্যক্ষভাবে আরবদের সিন্ধু অভিযানের তেমন কোন উল্লেখযােগ্য রাজনৈতিক ফলাফল ছিল না। লেনপুলের উপরিউক্ত মন্তব্যে তারই সমর্থন মেলে। কারণ, সিন্ধুতে আরবদের শাসন বেশিদিন স্থায়ী না হওয়ায় ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গণে তার প্রভাব লক্ষ করা যায় না। কেবল রাজা দাহিরের পতন ও মুসলিম প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর তেমন কোন প্রত্যক্ষ ফলাফল দেখা যায় না। অবশ্য প্রত্যক্ষভাবে এর রাজনৈতিক ফলাফল তেমন না থাকলেও পরােক্ষ রাজনৈতিক ফলাফলের দিক থেকে এ বিজয়কে নিষ্ফল বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। যেমন –
- প্রথমতঃ আরবদের সিন্ধু বিজয়ের অব্যবহিত পর হতে প্রায় ৩০০ বছর ধরে সিন্ধুর স্থানীয় মুসলিম শাসকরা স্বাধীনভাবে সিন্ধু ও মুলতান শাসন করেন।
- দ্বিতীয়তঃ সিন্ধু বিজয়ের ফলে ভারতীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে আরব ভীতির সৃষ্টি হয় এবং তারা আত্মরক্ষার নীতি অনুসরণ করেন।
- তৃতীয়তঃ পরবর্তী মুসলিম বিজেতাগণ এ বিজয় দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়।
সামাজিক ফলাফল: সিন্ধু বিজয়ের ফলে আরবগণ স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে আসে। অনেক মুসলিম সৈনিক হিন্দু রমনীদের বিবাহ করে। ফলে আর্য ও সেমিটিক জাতির সংমিশ্রণ ঘটে, যা ইন্দো-সেমেটিক জাতিগােষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি পায়। তারা ভারতে দীর্ঘদিন যাবৎ ইন্দো সেমেটিক সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে ভারতীয় সমাজের উপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে, মুলতান, দেবল, নিরুন প্রভৃতি এলাকায় মুসলমানরা সংখ্যাধিক্যতা লাভ করতে থাকে। ফলে এ সকল এলাকায় মুসলিম সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, গড়ে ওঠে অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা এবং বিস্তার লাভ করতে থাকে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা। আরবীয় ও ইসলামী রীতিনীতি এ সকল এলাকার হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। পাশাপাশি হিন্দু সমাজের অনেক প্রথা-পদ্ধতিও তারা গ্রহণ করে। ক্রমে উভয়ের মধ্যে সামাজিক সম্প্রীতি গড়ে উঠতে থাকে।
অর্থনৈতিক ফলাফল: আরবীয়দের সিন্ধু বিজয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী ফলদায়ক হয়। বণিক জাতি আরবীয়দের ব্যবসায় বাণিজ্য জল ও স্থল উভয় পথেই সম্প্রসারিত হয়। সিন্ধু ও মুলতানে অবস্থান করে তারা আরব ও ভারতের মধ্যে একটি বাণিজ্যিক সেতুবন্ধন রচনা করে। এতে ব্যবসায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট উভয় অঞ্চলের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে থাকে। আরবীয়দের ব্যবসায় বাণিজ্য ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের সীমারেখা পেরিয়ে অনতিকালের মধ্যে বঙ্গদেশের উপকূলবর্তী সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রামেও সম্প্রসারিত হয়। পরবর্তীতে তা আরাে সম্প্রসারিত হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে বিস্তৃত হয়। এভাবে আরবীয় বাণিজ্য যেমন মহাদেশীয় ও সামুদ্রিক বাণিজ্যে রূপ লাভ করে, তেমনি এর মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সাথে ভারতবর্ষের সামুদ্রিক বাণিজ্যিক সম্পর্কও প্রতিষ্ঠিত হয়।
ধর্মীয় ফলাফল: সিন্ধু বিজয়ের ফলে অনেক পীর, কামেল, দরবেশ ভারতবর্ষে এসে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। এভাবে পৌত্তলিকদের মধ্যে একেশ্বরের বাণী প্রচারিত হতে থাকে এবং মুসলমানদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পরবর্তীকালে মুসলিম অভিযানের সফলতায় অনেক সহায়ক হয়, সন্দেহ নেই। আর এর মূলে ছিল সিন্ধু বিজয়। সিন্ধু বিজয়ের মধ্য দিয়ে সেখানে ইসলামের বীজ বপন করা হয়। তাই শ্রীবাস্তব যথার্থই বলেছেন, 'আরবদের সিন্ধু বিজয় ভারতে ইসলামের বীজ বপনের ক্ষেত্র রচিত হয়, যা ভবিষ্যতের আক্রমণকারীদেরকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে আক্রমণের উৎসাহ প্রদান করে।'
সাংস্কৃতিক ফলাফল: সিন্ধু বিজয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল ছিল সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। এ বিজয়ের ফলে আরব ও ভারতীয়দের মধ্যে এক অপূর্ব সাংস্কৃতিক যােগাযােগ ও লেনদেনের সুযােগ সৃষ্টি হয়। ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, কিন্তু মুসলিম সংস্কৃতিতে এই বিজয়ের ফল খুব গভীর ও সুদূরপ্রসারী ছিল। ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বহু উপাদান আরবীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে এবং পরবর্তীকালে সেগুলাে আরবদের মাধ্যমে ইউরােপে বিস্তার লাভ করে। এরপর থেকে বহু ভারতীয় গ্রন্থ আরবি ভাষায় এবং বহু আরবীয় গ্রন্থ ভারতীয় ভাষায় অনুদিত হতে থাকে। হিন্দু ধর্ম, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, সঙ্গীত, লােকগীতি, সাহিত্য, স্থাপত্য, চিত্রশিল্প প্রভৃতি জ্ঞান আরবীয়রা নিজ দেশে বিস্তার সাধন করে। আব্বাসীয় খলিফাগণ বহু ভারতীয় মনীষীকে তাদের দরবারে আমন্ত্রণ জানান। আব্বাসীয় আমলে বাগদাদ যে বিশ্বের অন্যতম জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্রে পরিণত হয়, তাতে ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনন্য অবদান ছিল। এভাবে আরবীয় সভ্যতা সংস্কৃতি ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির পরশে সমৃদ্ধশালী হয়। ঐতিহাসিক হ্যাভেলের মতে, 'গ্রিস নয়, ভারতই ইসলামের প্রথম যুগে মুসলিমদেরকে দর্শন, গুহ্যধর্মীয় আদর্শ শিখিয়েছে এবং সাহিত্য, শিল্প ও স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রকাশে উৎসাহিত করেছে।' অন্যদিকে ভারতীয়গণও আরবীয়দের নিকট থেকে জ্ঞান বিজ্ঞান, বিশেষ করে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম প্রভৃতি ক্ষেত্রে জ্ঞান লাভ করে। আরবীয়দের ধর্মীয় সম্প্রীতি, সাম্য ও সহিষ্ণুতা ভারতীয়দের মাঝে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষ করে, বর্ণভেদ প্রথায় নিষ্পেষিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা এতে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়।
0 মন্তব্যসমূহ