হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা: Urban planning of the Harappan civilization.

হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা: Urban planning of the Harappan civilization.

প্রাচীন বিশ্বের সভ্যতার ইতিহাসে হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা (Indus Valley Civilization) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তার বিস্ময়কর নগর পরিকল্পনা, উন্নত পয়ঃপ্রণালী, দক্ষ পৌর প্রশাসন এবং সুসংগঠিত গ্রিড-ব্যবস্থার কারণে। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০–১৫০০ অব্দে বিকশিত এই সভ্যতার মানুষজন এমন এক নগরজীবন গড়ে তুলেছিলেন, যা সমকালীন মিশর, মেসোপটেমিয়া বা চীনের নগর সভ্যতার তুলনায় অনেক বেশি সংগঠিত এবং বিজ্ঞানসম্মত।

নিচে হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার প্রতিটি দিক বিস্তারিত আলোচনা করা হলো—

নগর বিন্যাস ও শ্রেণিবিভাগ:

হরপ্পা সভ্যতার অধিকাংশ নগরকে বড়ো দুই ভাগে বিভক্ত করা হত—

সিটাডেল বা দুর্গ অঞ্চল:

  • সাধারণত নগরের পশ্চিম প্রান্তে উঁচু ভূমিতে নির্মিত হত।
  • মোটা প্রাকার বা ইটপ্রাচীর দিয়ে সুরক্ষিত ছিল।
  • এখানে খাদ্য-শস্যাগার, প্রশাসনিক ভবন, স্নানাগার, সামরিক বা ধর্মীয় স্থাপনা ইত্যাদি থাকত।
  • শাসক শ্রেণি, অভিজাত কর্মচারী ও পুরোহিতবর্গ সম্ভবত এখানে বসবাস করত।

নিম্ন নগর বা মূল বসতি অঞ্চল:

  • সাধারণ মানুষ ও কারিগরদের বসবাসের এলাকা।
  • বসতবাড়িগুলি সুশৃঙ্খলভাবে রাস্তার দু’ধারে নির্মিত হত।
  • দুর্গ-অঞ্চলের তুলনায় অঞ্চলটি বিস্তৃত হলেও সুরক্ষায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল।

এমন সুসংগঠিত দুই-ভাগের নগরবিন্যাস তৎকালীন বিশ্বের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।

গ্রিড প্যাটার্নে নগর গঠন:

হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োসহ প্রায় সব শহরেই আধুনিক নগরায়ণের মতো চৌকো খোপে রাস্তা কেটে গ্রিডের মতো শহর সাজানো হয়েছিল।

  • প্রধান রাস্তা ছিল উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম অক্ষ বরাবর।
  • রাস্তা একে অপরকে সমকোণে ছেদ করত, ফলে শহরটি বর্গাকার ব্লকে বিভক্ত ছিল।
  • এটি নির্দেশ করে যে উন্নত প্রকৌশলবিদ অথবা নগর-পরিকল্পকরা এ সভ্যতা পরিচালনা করতেন।

এই গ্রিড ব্যবস্থা আজকের নিউইয়র্ক, দিল্লি বা চণ্ডীগড়ের মতো আধুনিক শহরেও ব্যবহৃত।

বাড়িঘর ও স্থাপত্যশৈলী:

হরপ্পার বাড়িঘরগুলো শুধু মজবুতই ছিল না, বরং গোপনীয়তা, জলনিকাশ, আলোর ব্যবস্থা—সব ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিকভাবে নির্মিত।

নির্মাণ উপাদান:

  • পোড়ামাটির ইট
  • রোদে শুকানো কাঁচা ইট
  • চুন-সুড়কি
    হরপ্পার ইটের মান এতই উন্নত ছিল যে সেগুলো আজও টিকে আছে।

বাড়ির ধরন:

  • একতলা ও দু’তলা বাড়ি উভয়ই ছিল।
  • প্রতিটি বাড়ির কেন্দ্রে থাকত আঙ্গিনা বা উঠোন
  • কক্ষগুলি উঠোনকে ঘিরে তৈরি।
  • ছিল ব্যক্তিগত কুয়ো, রান্নাঘর, স্নানাগার

জানালা ও আলোর ব্যবস্থা:

  • ঘরের বাইরের দেওয়ালে জানালা কম থাকলেও ছাদে বা উঁচু দেওয়ালে থাকত ঝাঝরি বা বায়ুচলাচলের পথ।
  • এতে গোপনীয়তা বজায় থাকত এবং আলো-বাতাস প্রবেশ করত।

এগুলো নির্দেশ করে যে হরপ্পাবাসীরা আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করত।

উন্নত রাস্তা ও পরিবহন ব্যবস্থা:

হরপ্পা সভ্যতার রাস্তা আজকের মান অনুযায়ীও বিস্ময়কর উন্নত ছিল।

  • প্রধান রাস্তার প্রস্থ ৩০ ফিট পর্যন্ত ছিল।
  • রাস্তা ছিল পাকা — পোড়ামাটির ইট ও চুন-সুড়কি দিয়ে বাঁধানো।
  • প্রতিটি মোড়ে পাকা পানীয় জলের কুয়ো
  • রাস্তার পাশে পা চলার পথ (footpath)
  • ছিল আবর্জনা ফেলার কুণ্ড
  • রাতের অন্ধকারে আলোর জন্য সম্ভবত প্রদীপের স্তম্ভ ছিল।

শস্যাগার (Granary):

হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে আবিষ্কৃত বিশাল শস্যাগারগুলি ছিল রাষ্ট্রীয় খাদ্যসংগ্রহ কেন্দ্র।

বৈশিষ্ট্য:

  • খুব বড় পাকা ইটের ঘর
  • শস্যের বাতাস চলাচলের জন্য ঘুলঘুলি
  • শস্যাগারের পাশে চাতাল, যেখানে শস্য মাড়াই হত
  • কাছেই শ্রমিকদের বাসস্থান

এটি প্রমাণ করে যে হরপ্পাবাসীরা কেন্দ্রীয় খাদ্যব্যবস্থা, ট্যাক্স সংগ্রহ এবং সরকারি মজুত ব্যবস্থার ধারণা ব্যবহার করত।

স্নানাগার — মহেঞ্জোদাড়োর “গ্রেট বাথ”:

হরপ্পা সভ্যতার সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপত্য হলো মহেঞ্জোদাড়োর গ্রেট বাথ

বৈশিষ্ট্য:

  • লম্বায় ৩৯ ফুট, চওড়ায় ২৩ ফুট এবং গভীরতায় ৮ ফুট
  • মেঝেতে জলরোধী বিটুমেন ব্যবহার
  • নোংরা জল বের করার আলাদা নর্দমা
  • পরিষ্কার জল ঢোকানোর আলাদা ঘর
  • চারপাশে ছিল পোশাক বদলানোর কক্ষ

এটি সম্ভবত ধর্মীয় শুদ্ধিকরণ বা আচার অনুষ্ঠান পরিচালনার কেন্দ্র ছিল।

পয়ঃপ্রণালী — বিশ্বের প্রাচীনতম স্যুয়ারেজ সিস্টেম:

হরপ্পা সভ্যতার সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো তাদের শ্যুয়ারেজ সিস্টেম, যা ৪,৫০০ বছর আগেও আধুনিক।

  • প্রতিটি বাড়ি থেকে বর্জ্য জল নর্দমার সঙ্গে যুক্ত ছিল।
  • পোড়ামাটির পাইপ ব্যবহার করা হত।
  • রাস্তার প্রধান নর্দমাগুলো ছিল ঢালাই পাথর বা ইটের স্ল্যাবে ঢাকা।
  • নর্দমায় নিয়মিত পরিষ্কার করার জন্য চেম্বার ছিল।
  • বৃষ্টির জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও উন্নত ছিল।

এমন বৈজ্ঞানিক ড্রেনেজ মিশর বা মেসোপটেমিয়াতেও ছিল না।

বাজার, শিল্পকেন্দ্র ও বাণিজ্যিক এলাকা:

হরপ্পার শহরে বাণিজ্য ও উৎপাদনের জন্য বিশেষ অঞ্চল ছিল—

  • পুঁতির কারখানা
  • ধাতুশিল্প কেন্দ্র
  • মৃৎশিল্প কর্মশালা
  • গুদামঘর
  • ঘাট ও জেটি (বিশেষত লোথালে)

এটি নির্দেশ করে যে শহরগুলো ছিল শক্তিশালী বাণিজ্যকেন্দ্র এবং বিদেশে (মেসোপটেমিয়া) বাণিজ্য হত।

উন্নত পৌর প্রশাসন:

এতো সুসংগঠিত নগর গঠনের পিছনে একটি দক্ষ পৌরব্যবস্থা ছিল, যার বৈশিষ্ট্য—

  • সমান্তরাল রাস্তা
  • গ্রিড পদ্ধতিতে বাড়িঘর
  • পাবলিক শৌচাগার
  • পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থা
  • নগরের নিরাপত্তা ও সঞ্চয় ব্যবস্থা
  • পরিকল্পিত বাজার এলাকা
  • জল ব্যবস্থাপনা

এটি প্রমাণ করে যে তারা উন্নত শাসনব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কাঠামো ব্যবহার করত।

উপসংহার:

হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা ছিল বিশ্বের প্রথম এবং সর্বাপেক্ষা উন্নত নগরায়ণ ব্যবস্থার অন্যতম উদাহরণ। সিটাডেল, গ্রিড-রাস্তা, রুবোস্ট বাড়িঘর, গ্রেট বাথ, উন্নত পয়ঃপ্রণালী, পাবলিক কুয়ো, শস্যাগার এবং দক্ষ পৌর প্রশাসন—সব মিলিয়ে এই সভ্যতা প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়।

সমকালীন মিশর, মেসোপটেমিয়া কিংবা চৈনিক সভ্যতাও হরপ্পার মতো এত পূর্ণাঙ্গ, বিজ্ঞানসম্মত ও স্বাস্থ্যকর নগর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। তাই হরপ্পা সভ্যতাকে যথার্থভাবেই বলা হয়—
“প্রাচীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নগর সভ্যতা”।

GKpathya.in হল সাধারণ জ্ঞান, সমসাময়িক বিষয় ও পরীক্ষামুখী তথ্যের ভাণ্ডার। আমি সুকান্ত দাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এম.এ এবং পেশায় শিক্ষক। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ও শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে সহায়তা করার জন্য সহজ ও নির্ভরযোগ্য কনটেন্ট শেয়ার করি।

error: Content is protected !!