লোকসভা এবং রাজ্যসভার মধ্যে সম্পর্ক: Relationship between Lok Sabha and Rajya Sabha.
ভূমিকা:
ভারতের সংসদ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট—লোকসভা ও রাজ্যসভা। দুই কক্ষের কার্যক্ষমতা, সাংবিধানিক ভূমিকা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে। একদিকে লোকসভা মানুষের সরাসরি ভোটে গঠিত নিম্নকক্ষ, অন্যদিকে রাজ্যসভা হলো রাজ্যগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে উচ্চকক্ষ। একের সাথে আরেক কক্ষের সম্পর্ক সহযোগিতা, পর্যালোচনা, নিয়ন্ত্রণ এবং সমন্বয়ের মাধ্যমে সংসদীয় শাসনব্যবস্থাকে কার্যকর ও ভারসাম্যপূর্ণ করে তোলে।
এই পোস্টে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব—লোকসভা এবং রাজ্যসভার মধ্যে সম্পর্ক, তাদের ক্ষমতাগত বৈসাদৃশ্য, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা, অর্থবিলের বিষয়ে দ্বিকক্ষের অবস্থান, সাংবিধানিক সংশোধন প্রক্রিয়া এবং ফেডারেল কাঠামো রক্ষায় দুই কক্ষের সমন্বয়।
লোকসভা ও রাজ্যসভার গঠনগত ভিত্তি:
ভারতের সংসদের দুই কক্ষের গঠনগত বৈশিষ্ট্য ভিন্ন, যা তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বুঝতে সাহায্য করে।
লোকসভা (House of the People):
- জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত।
- সর্বোচ্চ সদস্য সংখ্যা ৫৫২।
- মেয়াদ ৫ বছর।
- কেন্দ্রীয় সরকারের উপর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ রাখে।
রাজ্যসভা (Council of States):
- রাজ্য বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা পরোক্ষ নির্বাচিত।
- সর্বোচ্চ সদস্য সংখ্যা ২৫০।
- স্থায়ী কক্ষ—ভঙ্গ করা যায় না, শুধু প্রতি দুই বছরে ১/৩ সদস্য অবসর নেন।
- রাজ্যগুলির স্বার্থ রক্ষায় বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত।
লোকসভা এবং রাজ্যসভার মধ্যে মূল সম্পর্ক:
আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সম্পর্ক:
আইন প্রণয়ন হলো সংসদের প্রধান কাজ, এবং এই ক্ষেত্রে দুই কক্ষ পরস্পরের পরিপূরক।
সাধারণ বিল (Ordinary Bill):
- সাধারণ বিল যে কোনো কক্ষে উত্থাপন করা যায়।
- দুই কক্ষ একই বিল পাস না করা পর্যন্ত সেটি আইনে পরিণত হয় না।
- এক কক্ষ সংশোধন আনলে অন্য কক্ষকে তা পুনর্বিবেচনা করতে হয়।
- যদি দুই কক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য দীর্ঘস্থায়ী হয়, রাষ্ট্রপতি যৌথ অধিবেশন ডাকতে পারেন।
→ এই পরিস্থিতিতে লোকসভা সংখ্যায় বেশি হওয়ায় সাধারণত তাদের মতামত গুরুত্ব পায়।
অর্থবিলের ক্ষেত্রে (Money Bill) সম্পর্ক:
অর্থবিলের ক্ষেত্রে দুই কক্ষের ক্ষমতার পার্থক্য সবচেয়ে স্পষ্ট।
অর্থবিলের নিয়মাবলি:
- অর্থবিল শুধুমাত্র লোকসভায় উঠতে পারে।
- অর্থবিলের সিদ্ধান্তে রাজ্যসভার চূড়ান্ত মত নেই।
- রাজ্যসভা শুধুমাত্র সুপারিশ করতে পারে, কিন্তু লোকসভা তা মানতে বাধ্য নয়।
- রাজ্যসভা সর্বোচ্চ ১৪ দিনের জন্য অর্থবিল স্থগিত রাখতে পারে।
→ এখানে লোকসভা সম্পূর্ণভাবে প্রাধান্যশালী।
মন্ত্রিসভা ও নির্বাহী সম্পর্ক:
ভারতে সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় নির্বাহী ক্ষমতা সংসদের নিম্নকক্ষ—লোকসভার কাছে দায়বদ্ধ।
মন্ত্রিসভা-লোকসভা সম্পর্ক:
- প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ লোকসভার আস্থা না পেলে ক্ষমতাচ্যুত হন।
- লোকসভা “অনাস্থা প্রস্তাব” পাস করে সরকারকে অপসারণ করতে পারে।
- ফলে নির্বাহী ক্ষমতা লোকসভার উপর নির্ভরশীল।
মন্ত্রিসভা-রাজ্যসভা সম্পর্ক:
- রাজ্যসভা সরাসরি সরকারকে অপসারণ করতে পারে না।
- তবে প্রধানমন্ত্রী রাজ্যসভার সদস্য হতে পারেন (মনমোহন সিং ছিলেন উদাহরণ)।
- রাজ্যসভা তদারকির ভূমিকা পালন করলেও সরকারের স্থায়িত্ব নির্ভর করে লোকসভার উপর।
সাংবিধানিক সংশোধনীর ক্ষেত্রে সম্পর্ক:
সংবিধান পরিবর্তনে দুই কক্ষের ভূমিকা সমান।
৩৬৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী:
- সাংবিধানিক সংশোধনী পাসের জন্য দুই কক্ষেই বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন।
- এক কক্ষ পাস করলে অপর কক্ষ বাতিল করতে পারে না।
- এই ক্ষেত্রে যৌথ অধিবেশন নেই—উভয় কক্ষের সম্মতি অপরিহার্য।
এ ক্ষেত্রে লোকসভা ও রাজ্যসভা সম্পূর্ণ সমান মর্যাদাপ্রাপ্ত।
রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সম্পর্ক:
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন:
- লোকসভা ও রাজ্যসভার নির্বাচিত সদস্যরা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দেন।
- তাদের ভোটের মূল্য সমান নয়, বিশেষ সূত্র অনুযায়ী নির্ধারিত।
উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন:
- লোকসভা ও রাজ্যসভার সম্মিলিত সদস্যরা ভোট করেন।
- উপরাষ্ট্রপতি রাজ্যসভার পদাধিকারী সভাপতি।
যৌথ অধিবেশন: মতবিরোধে সমাধান:
যখন কোনো সাধারণ বিল নিয়ে দুই কক্ষের মধ্যে সমাধান আসে না, রাষ্ট্রপতি যৌথ অধিবেশন ডাকতে পারেন।
- যৌথ অধিবেশন লোকসভা স্পিকার পরিচালনা করেন।
- সদস্যসংখ্যায় লোকসভা বৃহৎ হওয়ায় সাধারণত লোকসভার অবস্থান প্রাধান্য পায়।
ফেডারেল কাঠামো রক্ষায় দুই কক্ষের সম্পর্ক:
ভারতের সাংবিধানিক কাঠামো ফেডারেল হলেও কেন্দ্র শক্তিশালী। দুই কক্ষ সেই ভারসাম্য বজায় রাখে।
লোকসভার ভূমিকা:
- জনমতের প্রতিফলন।
- কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারণে অধিক ক্ষমতা।
রাজ্যসভার ভূমিকা:
- রাজ্যের স্বার্থ রক্ষা, কেন্দ্রীয় আইন যেন রাজ্য স্বাধিকারক্ষেত্রে আঘাত না করে তা নিশ্চিত করা।
- বিজ্ঞান, অর্থনীতি, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণামূলক প্রতিবেদন তৈরি।
দুই কক্ষের সমন্বয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের স্বার্থ রক্ষা নিশ্চিত হয়।
লোকসভা ও রাজ্যসভার বৈসাদৃশ্য এবং পারস্পরিক নির্ভরশীলতা:
যদিও দুই কক্ষের ক্ষমতা ভিন্ন, তবুও তারা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল।
ভিন্নতা:
- লোকসভার ক্ষমতা বেশি—নির্বাহী নিয়ন্ত্রণ, অর্থবিল, অনাস্থা প্রস্তাব।
- রাজ্যসভার ক্ষমতা সীমিত, তবে কিছু ক্ষেত্রে সমান—সংবিধান সংশোধন, সাধারণ বিল, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন।
পারস্পরিক নির্ভরতা:
- আইন প্রণয়নে দুই কক্ষ সম্পূরক।
- বিভিন্ন বিল, কমিটি রিপোর্ট, বিতর্ক—সব ক্ষেত্রে দুই কক্ষের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।
- রাজ্যসভা লোকসভার তাড়াহুড়ো করে করা সিদ্ধান্তগুলো পর্যালোচনা করে—সাবধানী ভূমিকা পালন করে।
উপসংহার:
লোকসভা এবং রাজ্যসভা ভারতীয় সংসদীয় শাসনব্যবস্থার দুই স্তম্ভ।
একদিকে লোকসভা জনগণের ভোটে গঠিত বলে গণতান্ত্রিক বৈধতার কেন্দ্রবিন্দু, অন্যদিকে রাজ্যসভা রাজ্যগুলির স্বার্থ রক্ষার মাধ্যমে ফেডারেল কাঠামোকে দৃঢ় করে।
যেখানে লোকসভা অধিক ক্ষমতাশালী, সেখানে রাজ্যসভা পর্যালোচনা, পরামর্শ, ভারসাম্য ও রাজ্যের স্বার্থরক্ষার মাধ্যমে সংসদীয় ব্যবস্থাকে সুসংগঠিত করে তোলে।
এই পারস্পরিক সহযোগিতা, নিয়ন্ত্রণ ও সামঞ্জস্যই ভারতের শক্তিশালী গণতন্ত্রের চাবিকাঠি।



Post Comment