১৯৪৬ সালের নৌ বিদ্রোহ: কারণ, ঘটনা, বিশ্লেষণ ও গুরুত্ব: Naval mutiny of 1946.
ভূমিকা:
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা, INA–র বিচার এবং জ্বালাময়ী জনরোষ ইংরেজ সরকারের ভিত নড়িয়ে দিচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ে এক ঐতিহাসিক ঘটনা ভারতের স্বাধীনতার গতি আরও দ্রুততর করে তোলে। এটি হলো ১৯৪৬ সালের রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি বিদ্রোহ।
এই বিদ্রোহ শুধু সামরিক অবাধ্যতা নয়—বরং ছিল ব্রিটিশ অত্যাচার, বৈষম্য, বর্ণবিদ্বেষ এবং জাতীয়তাবাদের জোয়ারে গড়ে ওঠা এক বৃহত্তর প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি। ভারতের নৌসেনারা সংগঠিতভাবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করেছিল, তা ব্রিটিশ সামরিক কর্তৃত্বের ওপর বড় ধাক্কা দেয় এবং ইংরেজদের মনে সন্দেহ জাগায়—ভারত কি আদৌ আর তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে?
নৌ বিদ্রোহের পটভূমি:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ভারতীয় সেনা ও নৌবাহিনীর মধ্যে ক্ষোভ জমে উঠছিল। যুদ্ধের সময় ভারতীয় সৈন্যরা বিপুল ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করেছে, কিন্তু তাদের সুযোগ–সুবিধা ও বেতন বরাবরই ছিল ইউরোপীয় সৈন্যদের তুলনায় অনেক কম।
১.১ খাদ্য ও বেতন বৈষম্য:
- ভারতীয় নাবিকদের বেতন ছিল খুবই কম—ইউরোপীয়দের তুলনায় প্রায় এক–তৃতীয়াংশ।
- খাবারের মান ছিল এতটাই খারাপ যে বহু নাবিক প্রায় প্রতিদিন অসন্তোষ প্রকাশ করত।
- নৌ–বন্দরে ভারতীয়দের জন্য আলাদা এবং নিম্নমানের ক্যান্টিন ছিল; শ্বেতাঙ্গদের জন্য ছিল উন্নত সুবিধা।
১.২ শ্বেতাঙ্গ অফিসারদের বর্ণবিদ্বেষ:
অনেক ব্রিটিশ অফিসার ভারতীয় নাবিকদের অবজ্ঞাভরে দেখত, তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করত।
তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল—
“Indians are born to obey, not to question.”
এই অপমানজনক মনোভাব নাবিকদের ভেতরে বিদ্রোহী মানসিকতা তৈরি করে।
১.৩ INA বিচারপর্বের প্রভাব:
১৯৪৫-৪৬ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের (INA) সদস্যদের বিচার শুরু হয়।
সারা দেশের মতো নৌ–বাহিনীতেও আজাদ হিন্দের প্রতি সহানুভূতি তৈরি হয় এবং ব্রিটিশবিরোধী ভাবনা তীব্র হয়।
INA–র স্লোগান, গান, বক্তৃতা নৌসেনাদের মনেও দেশপ্রেমের আগুন জ্বালিয়ে দেয়, যা বিদ্রোহে বড় ভূমিকা নেয়।
বিদ্রোহের সূচনা — ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬:
২.১ বোম্বের INS Talwar–এ প্রথম স্ফুলিঙ্গ:
বিদ্রোহ শুরু হয় বোম্বের “INS Talwar” নামক সিগনাল ট্রেনিং স্কুলে।
নেতৃত্বে ছিলেন এম. এস. খান ও শওকত হায়াত।
নাবিকদের দাবি ছিল—
- ভালো খাবার
- বেতন বৃদ্ধি
- অপমান বন্ধ
- বৈষম্যমুক্ত আচরণ
- INA বন্দীদের মুক্তি
দাবি না মানায় নাবিকরা কাজ বন্ধ করে বিক্ষোভে নামে।
২.২ বোম্বাই জুড়ে বিদ্রোহের আগুন:
খুব দ্রুতই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে—
- ডকইয়ার্ড
- শোর–এস্টাবলিশমেন্ট
- বহু যুদ্ধজাহাজ
- নৌ–কার্যালয়
দু’দিনের মধ্যেই প্রায় ৭৮টি জাহাজ এবং ২০,০০০-এর বেশি নাবিক বিদ্রোহে যোগ দেন।
২.৩ ত্রিবর্ণ পতাকা উত্তোলন:
বিদ্রোহীরা সাহসীভাবে ব্রিটিশ পতাকা ‘Union Jack’ নামিয়ে ভারতীয় ত্রিবর্ণ পতাকা উত্তোলন করে।
এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ।
বিদ্রোহের বিস্তার — করাচি, কলকাতা, মাদ্রাজে আন্দোলন:
বোম্বের পর বিদ্রোহ আর থেমে থাকেনি।
পুরো ভারতীয় নৌবাহিনীর বিভিন্ন শাখায় প্রতিক্রিয়া দেখা যায়—
৩.১ করাচি:
করাচির নৌঘাঁটিতে বিদ্রোহ সবচেয়ে প্রচণ্ড আকার নেয়।
এখানেই সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয়।
৩.২ কলকাতা:
কলকাতা বন্দরেও নাবিকরা কাজ বন্ধ, বিক্ষোভ, পতাকা উত্তোলন করে প্রতিবাদ জানায়।
৩.৩ মাদ্রাজ:
মাদ্রাজ বন্দরে নাবিকরা সমবেতভাবে ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা করে এবং INA বন্দীদের মুক্তি দাবি করে।
ব্রিটিশ সরকারের প্রতিক্রিয়া:
৪.১ ব্রিটিশ সেনাদের আক্রমণ:
ইংরেজ সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে যুদ্ধজাহাজ থেকে গুলি চালায়।
বোম্বে বন্দরে কয়েক ঘণ্টা ধরে গোলাগুলি চলে।
৪.২ ভারতীয় আর্মির অস্বীকৃতি:
ব্রিটিশরা ভারতীয় সেনাদের বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব দিলে
অনেক ভারতীয় সৈন্য নাবিকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলতে অস্বীকৃতি জানায়।
এটি ব্রিটিশ শাসনের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ সংকেত।
জনসমর্থনের ঢেউ:
বিদ্রোহে ছাত্র, শ্রমিক, ডক–কর্মচারী, সাধারণ মানুষ ব্যাপক সমর্থন জানায়।
বোম্বে শহরে ৩ দিন ধরে ধর্মঘট চলে।
ট্রাম, ট্রেন, কারখানা সব বন্ধ হয়ে যায়।
মানুষের স্লোগান ছিল—
“RIN sailors are our brothers!”
বিদ্রোহের শেষ পরিণতি:
শেষ পর্যন্ত নৌ–সেনাপতি অ্যাডমিরাল গডফ্রে রেডিও বার্তায় নাবিকদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।
রাজনৈতিক নেতারা — বিশেষ করে সর্দার বল্লভভাই পটেল — শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে এগোন।
নাবিকরা আত্মসমর্পণ করলেও তারা ঘোষণা করেন—
“We have won the battle of minds. British can no longer rule India.”
নৌ বিদ্রোহের প্রধান কারণ:
১. বেতন ও কর্মপরিবেশে বৈষম্য:
ইউরোপীয়দের তুলনায় ভারতীয়দের সুবিধা খুব কম ছিল।
২. খাদ্য সমস্যার তীব্রতা:
নিম্নমানের বাসি খাবার পরিবেশন করা হত।
৩. বর্ণবিদ্বেষমূলক আচরণ:
ইংরেজ অফিসারদের তাচ্ছিল্য নাবিকদের আঘাত করত।
৪. বিপজ্জনক কাজে শুধুই ভারতীয়দের পাঠানো:
ঝুঁকিপূর্ণ নৌতৎপরতার মূল দায়িত্ব ভারতীয়দের ওপর থাকত।
৫. INA আন্দোলনের প্রভাব:
জাতীয়তাবাদী ভাবনায় উজ্জীবিত হয়ে নাবিকরা আন্দোলনে নামে।
১৯৪৬ সালের নৌ বিদ্রোহের গুরুত্ব:
৮.১ ব্রিটিশ সামরিক প্রশাসনের প্রতি আস্থা ভেঙে যায়:
ইংরেজ সরকার বুঝতে পারে ভারতীয় বাহিনী আর তাদের প্রতি অনুগত নয়।
৮.২ স্বাধীনতা আন্দোলনের গতি বহুগুণ বেড়ে যায়:
এই বিদ্রোহ ব্রিটিশ সরকারকে দ্রুত ভারত ছাড়ার প্রক্রিয়ায় বাধ্য করে।
৮.৩ সাধারণ মানুষ ও সেনাদের বিরল ঐক্য:
প্রথমবার সাধারণ মানুষ ও সেনারা একই দাবি নিয়ে একতাবদ্ধ হয়।
৮.৪ ভারতীয় বাহিনী রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠে:
তারা শুধু আদেশ মানার বাহিনী নয়—বরং স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখা এক শক্তিশালী জাতীয় বাহিনীতে পরিণত হয়।
উপসংহার:
১৯৪৬ সালের রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি বিদ্রোহ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
এই বিদ্রোহ দেখিয়ে দেয়—ভারতীয় সৈন্যরা আর ব্রিটিশদের হাতিয়ার হয়ে থাকতে রাজি নয়।
এটি কেবল একটি সামরিক বিদ্রোহ নয়; ছিল স্বাধীনতার তীব্র প্রত্যাশা, অপমানের প্রতিবাদ এবং সমগ্র জাতির যৌথ আবেগের বহিঃপ্রকাশ।
বিদ্রোহ দমন হলেও তার প্রভাব ছিল স্থায়ী।
এই ঘটনাই ব্রিটিশদের শেষ উপলব্ধি দেয়—ভারত শাসনের দিন শেষ।
তাই এক কথায় বলা যায়, RIN Mutiny ছিল স্বাধীনতার দরজায় শেষ ও সবচেয়ে শক্তিশালী ধাক্কা।



Post Comment