সার্বভৌমত্বের একত্ববাদী তত্ত্ব (Monistic Theory of Sovereignty):

সার্বভৌমত্বের একত্ববাদী তত্ত্ব (Monistic Theory of Sovereignty):

Table of Contents

ভূমিকা:

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সার্বভৌমত্ব এমন একটি ধারণা যা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও কার্যকারিতার মূলভিত্তি। একটি রাষ্ট্র তখনই পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হয় যখন তার ওপর অন্য কোনো রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান বা শক্তি কর্তৃত্ব আরোপ করতে পারে না। এই সার্বভৌমত্বকে ঘিরে বিভিন্ন তত্ত্ব গড়ে উঠেছে। তার মধ্যে একত্ববাদী তত্ত্ব (Monistic Theory of Sovereignty) সবচেয়ে প্রাচীন, শক্তিশালী এবং ঐতিহাসিকভাবে প্রভাবশালী মতবাদ।

একত্ববাদী তত্ত্বের মূল বক্তব্য হলো—রাষ্ট্রই সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী, আর আইন হলো সেই রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ মাত্র। জন অস্টিন এই তত্ত্বকে বৈজ্ঞানিক রূপ দেন। তবে আধুনিক যুগে এই তত্ত্ব নানা দিক থেকে সমালোচিত হয়ে বহুত্ববাদী তত্ত্বের উত্থান ঘটেছে।

এই নিবন্ধে আমরা একত্ববাদী তত্ত্বকে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব—

একত্ববাদী তত্ত্ব (Monistic Theory) কী?

এই তত্ত্ব অনুযায়ী, রাষ্ট্র হলো ক্ষমতার একমাত্র উৎস এবং সার্বভৌমত্ব তার হাতে কেন্দ্রীভূত। রাষ্ট্রের আদেশ ছাড়া কোনো আইন বা নিয়মের অস্তিত্ব নেই। জনগণ রাষ্ট্রের আদেশ মানে কারণ তারা অভ্যাসগত আনুগত্য (habitual obedience) প্রদর্শন করে।

অস্টিনের মতে—

“Law is the command of the sovereign backed by sanctions.”

এখানে তিনটি প্রধান বিষয় লক্ষ্যণীয়—

  1. সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ
  2. আইন হিসেবে গণ্য হওয়া
  3. অমান্য করলে শাস্তি

তাই একত্ববাদী তত্ত্ব মূলত রাষ্ট্রের একক ক্ষমতা ও তার আদেশের বাধ্যতামূলকতার উপর ভিত্তি করে গঠিত।

একত্ববাদী তত্ত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য

১. রাষ্ট্রের একক ও চূড়ান্ত ক্ষমতা (Supremacy of State)

এই তত্ত্বে রাষ্ট্রকে সর্বশক্তিমান হিসেবে দেখা হয়।

  • রাষ্ট্রের বাইরে কোনো ক্ষমতা নেই
  • রাষ্ট্রের আদেশই শেষ কথা
  • অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে নয়

এ কারণে একত্ববাদী তত্ত্বকে “state-centric theory” বলা হয়।

২. সার্বভৌমত্ব অবিভাজ্য (Indivisible)

সার্বভৌমত্বকে ভাগ করা যায় না।

  • আইনসভা, নির্বাহী ও বিচার বিভাগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উপাঙ্গ
  • কিন্তু সার্বভৌমত্বের উৎস একটিই—রাষ্ট্র
    যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাতেও ক্ষমতা ভাগ করা হলেও সার্বভৌমত্ব বিভক্ত হয় না—এমনটাই একত্ববাদীদের দাবি।

৩. সার্বভৌমত্ব সীমাহীন (Unlimited)

সার্বভৌম ক্ষমতার সীমা নেই।

  • রাষ্ট্র যেকোনো আইন তৈরি করতে পারে
  • রাষ্ট্রের আদেশ পালনে ব্যর্থ হলে শাস্তি
  • রাষ্ট্র কারও কাছে দায়বদ্ধ নয়

কারণ—রাষ্ট্রের উপরে আর কোনো শক্তি নেই।

৪. সার্বভৌমত্ব চিরস্থায়ী (Permanence of Sovereignty)

রাষ্ট্রের সরকার পরিবর্তন হতে পারে;
কিন্তু রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা বিনষ্ট হয় না।

  • একনায়ক → গণতান্ত্রিক সরকার
  • রাজতান্ত্রিক → প্রজাতন্ত্র
    এসব পরিবর্তন সার্বভৌম ক্ষমতার স্থায়িত্বে প্রভাব ফেলে না।

৫. আইন মানেই সার্বভৌমের আদেশ

অস্টিন আইনকে নৈতিকতা, ধর্ম, প্রথা থেকে আলাদা করেন।
তার মতে—

  • নৈতিকতা “কর্তব্য” সৃষ্টি করে
  • কিন্তু আইন “বাধ্যবাধকতা” সৃষ্টি করে
    আইনের বৈধতা শুধুমাত্র সার্বভৌমের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।

একত্ববাদী তত্ত্বের প্রবক্তাগণ

১. জন অস্টিন (John Austin)

  • ইংরেজ আইনদার্শনিক
  • Command Theory-এর প্রবর্তক
  • আইনকে নৈতিকতা থেকে আলাদা করেন
  • সার্বভৌম ক্ষমতার উৎসকে রাষ্ট্রের হাতে দেখান

তাকে একত্ববাদী তত্ত্বের ‘Father of Legal Positivism’ বলা হয়।

২. থমাস হবস্ (Hobbes)

  • মানব প্রকৃতিকে স্বার্থপর মনে করেছিলেন
  • অরাজকতা রোধে শক্তিশালী সার্বভৌম প্রয়োজন
  • রাষ্ট্রের পরম ক্ষমতার ধারণা প্রদান

৩. জ্যাঁ বোদাঁ (Jean Bodin)

  • প্রথম সার্বভৌমত্বকে “অবিভাজ্য” বলে তুলে ধরেন
  • রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন

৪. হল্যান্ড (Holland)

  • একত্ববাদী তত্ত্বের আইনতত্ত্বগত ভিত্তি শক্তিশালী করেন

একত্ববাদী তত্ত্বের গুরুত্ব

১. আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে তোলে

রাষ্ট্র, আইন, শাসনব্যবস্থা—এসবকে বৈজ্ঞানিক রূপ দেয়।

২. আইনের উৎস নির্ধারণ সহজ করে

আইন কে তৈরি করতে পারে—এই প্রশ্নের সরল উত্তর দেয়:
রাষ্ট্রই আইনের একমাত্র উৎস।

৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে

একক ক্ষমতার ধারণায়

  • রাষ্ট্র দৃঢ় হয়
  • প্রশাসন কার্যকর হয়
  • আইনশৃঙ্খলা বজায় থাকে

৪. সার্বভৌমত্বের ধারণা পরিষ্কার করে

পরম, স্থায়ী, অবিভাজ্য সার্বভৌমত্বের ধারণা রাজনৈতিক বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে।

একত্ববাদী তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা

আধুনিক গণতান্ত্রিক ও বহুমুখী সমাজে একত্ববাদী তত্ত্ব নানা কারণে সমালোচিত।

১. বহুত্ববাদীদের সমালোচনা (Pluralist Criticism)

ডাহল, লাস্কি, গিটার প্রমুখ বহুত্ববাদী তাত্ত্বিকরা বলেন—
সমাজে ক্ষমতা শুধু রাষ্ট্রের হাতে থাকে না।

  • শ্রমিক ইউনিয়ন
  • চার্চ
  • ট্রেড ইউনিয়ন
  • ব্যবসায়ী সমিতি
  • গণমাধ্যম
    এরা নানা সময় ক্ষমতা প্রয়োগ করে।
    অস্টিন যে “একক সর্বোচ্চ ক্ষমতা”-র কথা বলেছেন, তা বাস্তবে দেখা যায় না।

২. আইনের উৎস বহুমাত্রিক

একত্ববাদীরা আইনের একমাত্র উৎস রাষ্ট্র বলে মনে করেন।
কিন্তু আজকের দিনে আইনের উৎস—

  • আন্তর্জাতিক আইন
  • প্রথা
  • ধর্মীয় বিধান
  • সামাজিক রীতি
  • মানবাধিকার আইন
    এসবের ওপরও রাষ্ট্রকে নির্ভর করতে হয়।
    তাই আইন একক উৎস থেকে তৈরি হয় না।

৩. যুক্তরাষ্ট্রীয় (Federal) ব্যবস্থার সঙ্গে অসামঞ্জস্য

ফেডারেল রাষ্ট্রে ক্ষমতা ভাগ করা থাকে—

  • কেন্দ্র
  • রাজ্য
    এদের আলাদা ক্ষমতা সংবিধান স্বীকৃত।
    তাই সার্বভৌমত্বকে একক হিসেবে দেখা যায় না।

৪. রাষ্ট্রের “অসীম” ক্ষমতা অবাস্তব

আধুনিক রাষ্ট্র নানা শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত—

  • জনগণ
  • মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ
  • বিচার বিভাগ
  • সংবিধান
  • গণমাধ্যম
    এ কারণে রাষ্ট্র আজ “পরম” নয়।

৫. বাস্তববর্জিত ও অতিরিক্ত রাষ্ট্রকেন্দ্রিক

এই তত্ত্ব সমাজের জটিলতাকে উপেক্ষা করে।
রাষ্ট্রকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে দেখানো আজকের যুগে অবাস্তব।

উদাহরণ দিয়ে সমালোচনা স্পষ্ট ব্যাখ্যা

১. গণতন্ত্রে সার্বভৌম কে?

অস্টিন বলছেন, সার্বভৌম হলো “অভ্যাসগত আনুগত্যপ্রাপ্ত শাসক”,
কিন্তু গণতন্ত্রে সার্বভৌম হলো “জনগণ”।
তাহলে জনগণ কি নিজেরাই নিজের কাছে আনুগত্য করে?
এটি একত্ববাদীর জন্য একটি অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব।

২. ব্রিটিশ সংসদ—Real Example

ইংরেজরা বলেন,
“Parliament is supreme.”
কিন্তু এখানেও—

  • গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ
  • মানবাধিকার
  • আন্তর্জাতিক আইন
  • বিচার বিভাগের রায়
    এগুলির কারণে সংসদের ক্ষমতা সীমিত।
    তাই একত্ববাদী তত্ত্বের “সীমাহীন ক্ষমতা”-র ধারণা কার্যত অকার্যকর।

সমালোচনা সংক্ষেপে:

সমালোচনার কারণব্যাখ্যা
বহুত্ববাদক্ষমতা বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিভক্ত
আইনের বহুমুখী উৎসপ্রথা, ধর্ম, আন্তর্জাতিক আইন—এসবও আইন গঠন করে
ফেডারেল ব্যবস্থাক্ষমতা ভাগ করা হয়, একক নয়
রাষ্ট্র সর্বশক্তিমান নয়জনমত, বিচার বিভাগ রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে
রাষ্ট্রকেন্দ্রিকতাসমাজের বহুমাত্রিক চরিত্র উপেক্ষিত

আধুনিক যুগে একত্ববাদী তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা

যদিও এই তত্ত্ব সমালোচিত, তবুও কিছু ক্ষেত্রে আজও প্রাসঙ্গিক—

  • রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাঠামো বোঝাতে সাহায্য করে
  • আইন কোথা থেকে এসেছে তা ব্যাখ্যা দেয়
  • প্রশাসনিক আদেশের যৌক্তিকতা তৈরি করে
  • রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে

তাই আধুনিক সমাজে এই তত্ত্ব পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক নয়।
কিন্তু এটাকে একক সত্য হিসেবে ধরাও যায় না।

উপসংহার:

সার্বভৌমত্বের একত্ববাদী তত্ত্ব রাষ্ট্রকে ক্ষমতার উৎস হিসেবে তুলে ধরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গঠনমূলক ভিত্তি তৈরি করেছে। জন অস্টিনের মতো আইনবিদরা আইন ও রাষ্ট্রের সম্পর্ককে স্পষ্ট করেন। তবে আধুনিক বহুমুখী সমাজ, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, আন্তর্জাতিক আইন, গণতন্ত্রের বিকাশ—এসব কারণে এই তত্ত্ব সীমিত হয়ে পড়েছে।

সমাজের বাস্তবতা এখন বহুত্বমুখী, তাই সার্বভৌমত্বের আধুনিক ধারণা একত্ববাদ ও বহুত্ববাদ—উভয় তত্ত্বের সমন্বয়ে ব্যাখ্যা করা দরকার।

GKpathya.in হল সাধারণ জ্ঞান, সমসাময়িক বিষয় ও পরীক্ষামুখী তথ্যের ভাণ্ডার। আমি সুকান্ত দাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এম.এ এবং পেশায় শিক্ষক। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ও শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে সহায়তা করার জন্য সহজ ও নির্ভরযোগ্য কনটেন্ট শেয়ার করি।

error: Content is protected !!