মার্কসবাদের উৎস ও তাৎপর্য: marxism-origins-and-significance-bangla.

মার্কসবাদের উৎস ও তাৎপর্য: marxism-origins-and-significance-bangla.

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মার্কসীয় মতবাদ একটি সর্বাধুনিক এবং বৈপ্লবিক সংযোজন। উনিশ শতকে সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক চিন্তাধারার উন্মেষ ঘটে তার অন্যতম ফলশ্রুতি হল মার্কসবাদ। কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের যৌথ দর্শন ও তত্ত্বের ভিত্তিতেই মার্কসবাদ গঠিত। লেনিনের ভাষায়— “মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষাসূচিই মার্কসবাদ।” অর্থাৎ মানবসমাজের উৎপত্তি, বিকাশ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে সমাজ পরিবর্তনের যে বিশ্লেষণ মার্কস ও এঙ্গেলস করেন, তাকেই মার্কসবাদ বলা হয়।

মার্কসবাদের উৎস:

মার্কসবাদ কোনো একক উৎস থেকে উদ্ভূত হয়নি; এটি নানা ঐতিহাসিক ঘটনা ও তাত্ত্বিক ভাবধারার সম্মিলিত ফসল। মার্কসবাদের উৎসকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়— (১) ঐতিহাসিক উৎস এবং (২) তত্ত্বগত উৎস।

ঐতিহাসিক উৎস:

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইউরোপে দুটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে— ফরাসি বিপ্লব এবং শিল্পবিপ্লব। ফরাসি বিপ্লব মানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সাম্যবাদের ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছিল, আর শিল্পবিপ্লব অর্থনৈতিক কাঠামোকে আমূল বদলে দেয়। এর ফলে সমাজে এক নতুন শ্রেণির উদ্ভব ঘটে— শ্রমিক শ্রেণি বা প্রলেতারিয়েত

শিল্পপতিদের মুনাফালোভী নীতির ফলে শ্রমিক শ্রেণি অমানবিক শোষণের শিকার হয়। এরই প্রতিবাদে ইউরোপজুড়ে গড়ে ওঠে শ্রমিক আন্দোলন, যা ছিল সমাজ পরিবর্তনের প্রথম সজীব প্রচেষ্টা। এই আন্দোলনই মার্কসবাদের বাস্তব ভিত্তি রচনা করে। শ্রমজীবী মানুষের এই সংগ্রাম মার্কসকে অনুপ্রাণিত করেছিল একটি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক মতবাদ রচনায়।

তত্ত্বগত উৎস:

মার্কসবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি তিনটি প্রধান ধারার উপর প্রতিষ্ঠিত— জার্মান দর্শন, ব্রিটিশ অর্থশাস্ত্র, এবং ফরাসি সমাজতন্ত্র

জার্মান দর্শন:

মার্কস জার্মান দার্শনিক হেগেল এবং ফয়েরবাখ-এর চিন্তা থেকে গভীরভাবে প্রভাবিত হন। হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি বা ডায়ালেক্টিক মেথড মার্কসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তবে হেগেল ছিলেন ভাববাদী; তিনি আত্মার বিকাশের মাধ্যমে ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করেন। মার্কস এই ভাববাদকে উল্টে দিয়ে বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতা (Dialectical Materialism) প্রতিষ্ঠা করেন। অপরদিকে, ফয়েরবাখের কাছ থেকে তিনি বস্তুবাদী দর্শন গ্রহণ করে সমাজ জীবনে তার প্রয়োগ ঘটান। এর ফলেই মার্কসের সমাজ বিশ্লেষণ পায় বৈজ্ঞানিক ভিত্তি।

ব্রিটিশ অর্থশাস্ত্র:

ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথডেভিড রিকার্ডো মার্কসকে তাত্ত্বিকভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। স্মিথ শ্রমের মাধ্যমে দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণের কথা বলেন, যা পরে রিকার্ডো বিশ্লেষণাত্মকভাবে ব্যাখ্যা করেন। মার্কস এই শ্রমতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে দেখান যে, শ্রমিক তার শ্রমের পূর্ণ মূল্য পায় না—একটি অংশ পুঁজিপতির হাতে উদ্বৃত্ত হিসাবে থেকে যায়। এই ধারণা থেকেই মার্কস আবিষ্কার করেন তার বিখ্যাত উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব (Surplus Value Theory), যা পুঁজিবাদী শোষণের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ প্রদান করে।

ফরাসি সমাজতন্ত্র:

ফরাসি সমাজতন্ত্রী চিন্তাবিদ যেমন সাঁ সিমোঁ, শার্ল ফুরিয়ে, ও কাবে প্রমুখ মার্কসের চিন্তাকে প্রভাবিত করেন। এঁরা সমাজে সমতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থার কথা বলেছিলেন। মার্কস তাঁদের এই আদর্শবাদী সমাজতন্ত্রকে বাস্তবভিত্তিক করে তুলেছিলেন, যার ফলে জন্ম নেয় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র (Scientific Socialism)।

উপসংহার:

সবমিলিয়ে বলা যায়, মার্কসবাদ কোনো একক ব্যক্তির চিন্তার ফল নয়; এটি মানবসভ্যতার ঐতিহাসিক বিকাশের এক যৌক্তিক ধারা। ফরাসি বিপ্লব, শিল্পবিপ্লব, জার্মান দর্শন, ব্রিটিশ অর্থনীতি ও ফরাসি সমাজতন্ত্র—সবকিছু মিলিয়েই গঠিত হয়েছে মার্কসবাদ।

মার্কসবাদ একাধারে দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনীতির ত্রিমাত্রিক সংমিশ্রণ। এর মূল লক্ষ্য—সমাজ থেকে শোষণ দূর করে শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। তাই মার্কসবাদ কেবল একটি মতবাদ নয়, এটি সমাজ পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা আজও আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনৈতিক তত্ত্বে অপরিহার্য প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।

GKpathya.in হল সাধারণ জ্ঞান, সমসাময়িক বিষয় ও পরীক্ষামুখী তথ্যের ভাণ্ডার। আমি সুকান্ত দাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এম.এ এবং পেশায় শিক্ষক। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ও শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে সহায়তা করার জন্য সহজ ও নির্ভরযোগ্য কনটেন্ট শেয়ার করি।

Post Comment

error: Content is protected !!