আন্তর্জাতিক সম্পর্কে মার্কসবাদ-এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো: marxism-in-international-relations-bangla.
ভূমিকা:
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় মার্কসবাদ এক স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি। কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এই তত্ত্ব আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে অর্থনৈতিক ও শ্রেণিগত প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করে। যেখানে অন্য তত্ত্বগুলো রাষ্ট্রকে প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে, সেখানে মার্কসবাদ রাষ্ট্র নয়, বরং শ্রেণি ও অর্থনৈতিক কাঠামোকেই মূল বিশ্লেষণধারা হিসেবে গ্রহণ করেছে।
অর্থনৈতিক উপাদানের প্রাধান্য:
মার্কসবাদী তত্ত্ব অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক স্বার্থ ও নিয়ন্ত্রণ। আন্তর্জাতিক স্তরে যুদ্ধ, প্রতিযোগিতা ও রাজনৈতিক সংঘাতের প্রধান কারণ অর্থনৈতিক বৈষম্য। বিশ্বব্যবস্থার অর্থনৈতিক কাঠামোই হল “ভিত্তি” (Base), আর রাজনীতি, আইন, কূটনীতি ইত্যাদি তার “উপরিকাঠামো” (Super Structure)। উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক স্বার্থে স্বল্পোন্নত দেশগুলিকে নির্ভরশীল করে রেখেছে—এটাই আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তব চিত্র।
আন্তর্জাতিক স্তরে শ্রেণি চরিত্রের গুরুত্ব:
মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রকে নয়, বরং শ্রেণিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল কেন্দ্র বলে মনে করেন। তাদের মতে, বিশ্বকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়—শাসক শ্রেণি (Bourgeoisie) ও শোষিত শ্রেণি (Proletariat)। আন্তর্জাতিক রাজনীতি মূলত এই শ্রেণিদ্বয়ের সংঘাতেরই বহিঃপ্রকাশ।
শ্রেণিসংগ্রামের গুরুত্ব:
মার্কসীয় বিশ্লেষণ অনুসারে, বিশ্বরাজনীতি হলো শ্রেণিসংগ্রামের ধারাবাহিক রূপ। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে ‘have’ শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে এবং ‘have nots’ শ্রেণিকে শোষণ করে। এই শোষণ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।
সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা:
মার্কসবাদীদের মতে, সাম্রাজ্যবাদ হলো পুঁজিবাদের উন্নত রূপ। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো তাদের অতিরিক্ত পুঁজির বিনিয়োগ ও উৎপাদিত পণ্যের বাজার তৈরি করতে উপনিবেশ স্থাপন করে। আধুনিক যুগে এই প্রক্রিয়া নয়া সাম্রাজ্যবাদ (Neo-Imperialism) আকারে অব্যাহত রয়েছে। মার্কসবাদ এই আর্থিক শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদের তীব্র বিরোধিতা করে এবং শোষণমুক্ত বিশ্ব প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়।
জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার:
মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিটি জাতির স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের উপনিবেশভুক্ত ও অবদমিত জাতিগুলির মুক্তি ছাড়া বিশ্বশান্তি সম্ভব নয়। প্রকৃত শান্তি আসবে তখনই, যখন শ্রেণিহীন ও রাষ্ট্রহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ:
মার্কসবাদীদের মতে, সর্বহারাদের কোনো নির্দিষ্ট দেশ নেই—তারা সর্বত্রই শোষিত ও নিপীড়িত। তাই বিশ্বের সর্বহারাদের একত্রিত হয়ে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব করতে হবে। এই “সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ” (Proletarian Internationalism) বিশ্বশ্রমিক শ্রেণির ঐক্যের প্রতীক।
বিশ্ববিপ্লবে গুরুত্বদান:
মার্কসবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, কেবল একটি রাষ্ট্রে নয়, বরং সমগ্র বিশ্বে বিপ্লবের মাধ্যমেই প্রকৃত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বিশ্ববিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে বৈষম্য ও যুদ্ধের অবসান ঘটবে এবং স্থাপিত হবে এক শ্রেণিহীন, ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা।
উপসংহার:
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মার্কসবাদ এক নতুন বিশ্লেষণধারা উপহার দিয়েছে, যেখানে অর্থনীতি ও শ্রেণিসংগ্রামই মূল চালিকাশক্তি। যদিও এই তত্ত্ব বিশ্ব সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সেই স্বপ্ন অনেকটাই ম্লান হয়েছে। তবুও আন্তর্জাতিক রাজনীতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক বিশ্লেষণে মার্কসবাদ আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ এটি বিশ্বরাজনীতির পেছনের বাস্তব অর্থনৈতিক শক্তিগুলিকে উন্মোচিত করে।


Post Comment