ভারতের জাতীয় আন্দোলন (১৯০৫–১৯৪০): The Indian national movement (1905–1940).

ভারতের জাতীয় আন্দোলন (১৯০৫–১৯৪০): The Indian national movement (1905–1940).

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রায় দুই শতাব্দীব্যাপী হলেও, ১৯০৫ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত সময়কে আধুনিক জাতীয় আন্দোলনের উত্থান, বিকাশ এবং বিস্তারের যুগ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই সময়কে সাধারণত তিনটি ধাপে ভাগ করা হয়—

  • পর্ব ১ (১৯০৫–১৯২০)
  • পর্ব ২ (১৯২০–১৯৩০)
  • পর্ব ৩ (১৯৩১–১৯৪০)।

প্রত্যেক পর্বে জাতীয়তাবাদী চেতনার পরিবর্তন, রাজনৈতিক সংগঠন, আন্দোলনের ধরন এবং জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রায় ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়।

Table of Contents

পর্ব ১: ভারতের জাতীয় আন্দোলন (১৯০৫–১৯২০).

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের গঠন ও প্রাথমিক ধাপ (১৮৮৫).

১৮৮৫ সালে অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম‘র উদ্যোগে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয়। প্রথম অধিবেশনটি বোম্বেতে, ওয়োমেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়‘র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়।
আদ্যিকালে কংগ্রেস ছিল মধ্যপন্থী—তারা সংবেদনশীল দাবির পরিবর্তে ধীরে ধীরে সংস্কারের পক্ষে ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের ক্রমাগত দমনমূলক আচরণের কারণে কংগ্রেসের মধ্যেই জন্ম নেয় চরমপন্থী দল—লাল, বাল, পাল

বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) ও তার প্রভাব:

লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করেন। পূর্ব বাংলা ও আসামকে পৃথক করে ব্রিটিশরা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল।
এর বিরোধিতায় সমগ্র বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জোয়ার ওঠে এবং এভাবেই ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের সত্যিকার সূচনা ঘটে।

স্বদেশী আন্দোলন (১৯০৫).

  • বিদেশী পণ্য বর্জন,
  • দেশীয় শিল্পের সমর্থন,
  • মিলন মেলা, সমিতি ও গণআন্দোলন
    স্বদেশী আন্দোলনকে জনগণমুখী রূপ দিয়েছিল।

আইএনসি ১৯০৫ সালের বেনারস অধিবেশনে প্রথম স্বদেশীর সমর্থন জানায়।

মুসলিম লীগের গঠন (১৯০৬).

ঢাকায় আগাখান, নবাব সলিমুল্লাহ ও মহসিন-উল-মুলক মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন।
লীগ বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করে এবং মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি তোলে।

সুরাট বিভাজন (১৯০৭).

চরমপন্থী এবং মধ্যপন্থীদের তীব্র মতপার্থক্যের ফলে কংগ্রেসে বিভক্তি দেখা দেয়—যা আন্দোলনের ধারায় বড় প্রভাব ফেলে।

মিন্টো–মরলি সংস্কার (১৯০৯).

এতে প্রথমবারের মতো মুসলমানদের জন্য পৃথক ভোটার ব্যবস্থা চালু হয়।
এটি ছিল ব্রিটিশদের “Divide and Rule” নীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

গদর পার্টি (১৯১৩).

প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের দ্বারা গঠিত এই সংগঠন ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামকে উৎসাহিত করে।

হোমরুল আন্দোলন (১৯১৬).

বাল গঙ্গাধর তিলকঅ্যানি বেসান্ত ভারতীয়দের স্বরাজ অর্জনের লক্ষ্যে এই আন্দোলন শুরু করেন।
তিলকের বিখ্যাত উক্তি—
“স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার, এবং আমি তা নিতেই হবে।”

লখনউ চুক্তি (১৯১৬).

কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একসাথে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যৌথ দাবিতে এক হয়। এটি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের বিরল উদাহরণ।

রাওলাট আইন (১৯১৯).

বিচার ছাড়াই গ্রেপ্তার ও কারাবাসের অনুমতি প্রদানকারী এই আইন ভারতজুড়ে তীব্র বিরোধ সৃষ্টি করে।

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড (১৩ এপ্রিল ১৯১৯).

জেনারেল ডায়ারের নির্বিচার গুলিবর্ষণে শত শত নিরীহ মানুষ নিহত হন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিবাদে তার নাইটহুড ফিরিয়ে দেন।

খিলাফৎ আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০).

মোঃ আলী ও শওকত আলীর নেতৃত্বে খিলাফৎ আন্দোলন শুরু হলে গান্ধীজী তা সমর্থন করেন।
গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন ছিল প্রথম সর্বভারতীয় জনপ্রিয় গণআন্দোলন।

পর্ব ২: ভারতের জাতীয় আন্দোলন (১৯২০–১৯৩০).

চৌরি-চৌরা ঘটনা (১৯২২).

এক সংঘর্ষে ২২ জন পুলিশ নিহত হলে গান্ধীজী আন্দোলন স্থগিত করেন।

সাইমন কমিশন বয়কট (১৯২৭).

কমিশনে একটিও ভারতীয় না থাকায় দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়—
“Simon Go Back” স্লোগান ছড়িয়ে পড়ে।

লাঠিচার্জে লালা লাজপত রায় গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

লাহোর অধিবেশন (১৯২৯): পূর্ণ স্বরাজ ঘোষণা:

জওহরলাল নেহরুর সভাপতিত্বে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতাকে জাতীয় লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
২৬ জানুয়ারি ১৯৩০ প্রথম স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়।

বিপ্লবী আন্দোলনের বিস্তার:

বাংলা, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্রসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিপ্লবী সংগঠনগুলি ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয় ছিল।

উল্লেখযোগ্য ঘটনা:

  • ক্ষুদিরাম বোসপ্রফুল্ল চাকীর কিংসফোর্ড হত্যাচেষ্টা
  • ভগত সিং, রাজগুরু, সুখদেব–এর লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা
  • সূর্য সেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন (১৯৩০)
  • চন্দ্রশেখর আজাদ‘র আত্মবলিদান

দান্ডি অভিযান (১৯৩০):

গান্ধীজীর লবণ সত্যাগ্রহ ছিল সিভিল অবাধ্যতা আন্দোলনের সূচনা।
সাবরমতী আশ্রম থেকে ২৪০ মাইল পায়ে হেঁটে দান্ডিতে পৌঁছে গান্ধীজী এক মুঠো লবণ তুলে আইন অমান্য করেন।

প্রথম গোলটেবিল সম্মেলন (১৯৩০).

  • কংগ্রেস এতে যোগ দেয়নি।
  • ভারতের সাংবিধানিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হলেও ফল বিশেষ হয়নি।

পর্ব ৩: ভারতের জাতীয় আন্দোলন (১৯৩১–১৯৪০).

গান্ধী–ইরউইন চুক্তি (১৯৩১).

  • রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি
  • লবণ প্রস্তুতির স্বাধীনতা
  • সিভিল অবাধ্যতা আন্দোলন স্থগিত

এই চুক্তির ফলে গান্ধীজী দ্বিতীয় গোলটেবিল সম্মেলনে অংশ নেন।

দ্বিতীয় গোলটেবিল সম্মেলন (১৯৩১).

সংখ্যালঘু সমস্যায় ঐকমত্য না হওয়ায় আলোচনা ব্যর্থ হয়।

সাম্প্রদায়িক পুরস্কার (১৯৩২).

রামসে ম্যাকডোনাল্ড নিপীড়িত শ্রেণীসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়কে পৃথক নির্বাচনী অধিকার প্রদান করেন।
গান্ধীজি তার প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন।

পুনা চুক্তি (১৯৩২).

বি.আর. আম্বেদকর ও গান্ধীজীর আলোচনার মাধ্যমে এই সমঝোতা হয়।
পৃথক নির্বাচনের পরিবর্তে হতাশাগ্রস্ত শ্রেণীর জন্য সংরক্ষিত আসন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়।

তৃতীয় গোলটেবিল সম্মেলন (১৯৩২).

  • কংগ্রেস অনুপস্থিত থাকায় সম্মেলন ছিল অকার্যকর।
  • পরবর্তী সময়ে ভারত সরকার আইন, ১৯৩৫ প্রণীত হয়—যা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে।

পাকিস্তান দাবির উত্থান:

  • ১৯৩০ সালে মোহাম্মদ ইকবাল উত্তর-পশ্চিম প্রদেশগুলিকে নিয়ে মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের ধারণা দেন।
  • ১৯৩৩ সালে রহমত আলী “পাকিস্তান” শব্দটি প্রস্তাব করেন।
  • ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ লাহোর প্রস্তাবে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি করে।

উপসংহার:

১৯০৫ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত ভারতের জাতীয় আন্দোলন ছিল বহুমাত্রিক—
কংগ্রেসের গণআন্দোলন, খিলাফৎ আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন, বিপ্লবী সংগ্রাম, সাইমন বয়কট, ডান্ডি অভিযান, পূর্ণ স্বরাজ দাবি, বিভিন্ন চুক্তি ও সাংবিধানিক প্রস্তাব—এসবের সম্মিলিত প্রভাবেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদ তার পূর্ণতা পায়।
এই সময়ের সংগ্রামই পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন করে।

GKpathya.in হল সাধারণ জ্ঞান, সমসাময়িক বিষয় ও পরীক্ষামুখী তথ্যের ভাণ্ডার। আমি সুকান্ত দাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এম.এ এবং পেশায় শিক্ষক। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ও শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে সহায়তা করার জন্য সহজ ও নির্ভরযোগ্য কনটেন্ট শেয়ার করি।

error: Content is protected !!