আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির পার্থক্য | International Relations vs International Politics.
ভূমিকা:
সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি নবীন শাস্ত্র। সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও জটিল ও বিস্তৃত হয়েছে। ফলে দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রভৃতি শাস্ত্রের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে বিকশিত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্গত ছিল, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি একটি স্বতন্ত্র গবেষণাযোগ্য শাস্ত্রের মর্যাদা লাভ করে।
উৎপত্তি ও বিকাশ:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে আলাদা শাস্ত্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস দেখা যায়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এই শাস্ত্রের বিকাশকে ত্বরান্বিত করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ন্যাটো’, ‘সেন্টো’, ‘সিয়াটো’-র মতো জোট গঠন করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন করে ‘ওয়ারশ চুক্তি’। এইভাবে বিশ্ব রাজনীতি শক্তির রাজনীতিতে রূপান্তরিত হয়।
অন্যদিকে, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মিশর প্রভৃতি দেশ ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন’ শুরু করে, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা:
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কোনো একক বা সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই। বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্নভাবে একে ব্যাখ্যা করেছেন।
- হার্টম্যান বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল এমন একটি শাস্ত্র যা বিভিন্ন রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে।
- কুইনসি রাইট বলেন, অনিশ্চিত সার্বভৌম সংগঠনগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়েই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা।
- পামার ও পারকিন্স মতে, বিশ্বের মানুষ ও গোষ্ঠীর যাবতীয় সম্পর্ক, তাদের কার্যকলাপ ও চিন্তার প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি, প্রভাব ও প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলোচনা করে।
- হলস্টি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্বাধীন রাজনৈতিক রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক ক্রিয়া ও সম্পর্কের বিশ্লেষণ।
গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা:
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এমন একটি শাস্ত্র যা রাষ্ট্র ও অরাষ্ট্রীয় সংগঠন, আন্তর্জাতিক সংস্থা, কূটনীতি, যুদ্ধ ও শান্তি, নিরস্ত্রীকরণ, জাতীয় স্বার্থ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, সন্ত্রাসবাদ, বিশ্বায়ন ও পরিবেশগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। অর্থাৎ এটি বিশ্ব রাজনীতির পাশাপাশি মানবজীবনের প্রায় প্রতিটি দিককেই স্পর্শ করে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ধারণা:
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সমাজবিজ্ঞানের একটি নবীন শাখা। এটি রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সম্পর্কের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলি বিশ্লেষণ করে।
পামার ও পারকিন্স-এর মতে, “বিশ্বের সকল মানুষ ও গোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক, কার্যকলাপ ও চিন্তার উপর প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি ও প্রক্রিয়াগুলি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলোচনা করে।”
অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং মানবজীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের মিথস্ক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির ধারণা:
আন্তর্জাতিক রাজনীতি হল এমন একটি শাস্ত্র, যা রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা, মতানৈক্য, বিরোধ ও সংঘর্ষ নিয়ে আলোচনা করে। এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি উপশাখা, যেখানে ক্ষমতা, জাতীয় স্বার্থ, যুদ্ধ, শান্তি, কূটনীতি প্রভৃতি বিষয় মুখ্য।
হান্স মর্গ্যানথাউ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Politics Among Nations -এ আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ক্ষমতার সংগ্রাম হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
পরিধিগত পার্থক্য:
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিধি আন্তর্জাতিক রাজনীতির তুলনায় অনেক বিস্তৃত।
এটি রাজনৈতিক বিষয়ের পাশাপাশি অর্থনীতি, আইন, সংস্কৃতি, বাণিজ্য, পরিবেশ, যোগাযোগ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্যাবলি নিয়ে আলোচনা করে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি প্রধানত ক্ষমতার রাজনীতি, সংঘাত ও প্রতিযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
বিষয়বস্তুগত পার্থক্য:
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্য বিষয় সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা উভয়ই হতে পারে, কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতি মূলত সংঘাত, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও শক্তির ভারসাম্য নিয়ে কাজ করে।
সুতরাং আন্তর্জাতিক রাজনীতি হল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি সংকীর্ণ অংশ।
প্রকৃতিগত পার্থক্য:
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি তাত্ত্বিক ও প্রয়োগযোগ্য সামাজিক বিজ্ঞান, যেখানে বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের সার্বিক বিশ্লেষণ করা হয়।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বাস্তবধর্মী ও শক্তিনির্ভর একটি শাস্ত্র, যার মূল লক্ষ্য ক্ষমতার ব্যবহার ও তার ফলাফল বিশ্লেষণ।
পারস্পরিক সম্পর্ক:
আন্তর্জাতিক রাজনীতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্তর্গত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপবিভাগ।
অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনার বৃহত্তর কাঠামোর মধ্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতি একটি বিশেষ ক্ষেত্র, যা ক্ষমতার রাজনীতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়।
উপসংহার:
সবশেষে বলা যায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হলেও উভয়ের প্রকৃতি ও পরিধি পৃথক। আন্তর্জাতিক রাজনীতি যেখানে রাষ্ট্রসমূহের ক্ষমতার লড়াই ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে কাজ করে, সেখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সহযোগিতা, বাণিজ্য, কূটনীতি ও বিশ্বশান্তির দিকেও সমান গুরুত্ব দেয়। সুতরাং আন্তর্জাতিক রাজনীতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি অংশ মাত্র, কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি বহুমাত্রিক ও ব্যাপক ক্ষেত্র, যা গোটা বিশ্ব সমাজের আন্তঃসম্পর্ককে প্রতিফলিত করে।


Post Comment