হাইকোর্টের গঠন ৷ হাইকোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলী: High Court. Powers and functions of the High Court.

হাইকোর্টের গঠন ৷ হাইকোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলী: High Court. Powers and functions of the High Court.

ভারতের সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক রাজ্যে একটি করে হাইকোর্ট থাকবে। সংবিধানের ২১৪ নং ধারা অনুসারে রাজ্যভিত্তিক হাইকোর্ট গঠনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে সপ্তম সংবিধান সংশোধনী (১৯৫৬) অনুযায়ী দুই বা ততোধিক রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য একটি যৌথ হাইকোর্ট গঠন করা যেতে পারে। বর্তমানে ভারতের ২৮টি রাজ্য ও ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য মোট ২৫টি হাইকোর্ট কার্যরত রয়েছে।

হাইকোর্টের গঠন:

সংবিধানের ২১৬ নং ধারা অনুযায়ী, প্রত্যেক হাইকোর্টে একজন প্রধান বিচারপতি ও এক বা একাধিক অন্যান্য বিচারপতি থাকেন। যদি প্রধান বিচারপতির পদ সাময়িকভাবে শূন্য থাকে, তবে রাষ্ট্রপতি হাইকোর্টের বিচারপতিদের মধ্য থেকে কাউকে কার্যনির্বাহী প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত করতে পারেন (ধারা ২২৩)। এছাড়া কাজের চাপ বৃদ্ধি পেলে রাষ্ট্রপতি যোগ্য ব্যক্তিদের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করতে পারেন, যাঁদের মেয়াদ সর্বাধিক দুই বছর (ধারা 224(2))।

হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ:

সংবিধানের ২১৭ নং ধারা অনুযায়ী হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ রাষ্ট্রপতি করেন। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজ্যপাল ও সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করতে হয়। অন্য বিচারপতিদের নিয়োগের সময় রাষ্ট্রপতি রাজ্যপাল, সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং সংশ্লিষ্ট হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করেন।

হাইকোর্টের বিচারপতিদের যোগ্যতা:

হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট যোগ্যতা প্রয়োজন।

  • প্রার্থীকে অবশ্যই ভারতের নাগরিক হতে হবে।
  • তিনি কোনো হাইকোর্টে বা দুই বা ততোধিক হাইকোর্টে অন্তত দশ বছর অ্যাডভোকেট হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
  • অথবা ভারতের কোনো বিচার বিভাগীয় পদে দশ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
  • অ্যাডভোকেট ও বিচার বিভাগীয় পদে যৌথভাবে দশ বছরের অভিজ্ঞতাও গ্রহণযোগ্য।

হাইকোর্টের বিচারপতিদের কার্যকাল ও বেতন:

হাইকোর্টের বিচারপতিরা ৬২ বছর বয়স পর্যন্ত দায়িত্বে থাকতে পারেন। অবসর গ্রহণের পর তাঁরা সুপ্রীম কোর্ট বা অন্য কোনো হাইকোর্টে ওকালতি করতে পারেন না (ধারা ২২০)। রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনে হাইকোর্টের বিচারপতিদের অন্য রাজ্যের হাইকোর্টে বদলি করতে পারেন (ধারা ২২২)।
বর্তমানে প্রধান বিচারপতির মাসিক বেতন ₹২,৫০,০০০ টাকা এবং অন্যান্য বিচারপতির বেতন ₹২,২৫,০০০ টাকা। এই বেতন দেওয়া হয় সঞ্চিত তহবিল (Consolidated Fund) থেকে।

হাইকোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলী:

ভারতের বিচারব্যবস্থায় হাইকোর্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। এটি রাজ্য স্তরের সর্বোচ্চ আদালত, যার ক্ষমতা ও কার্যক্ষেত্র সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত। সংবিধানের ধারা ২১৫ অনুসারে, প্রত্যেক হাইকোর্ট একটি Court of Record বা অভিলেখ আদালত হিসেবে বিবেচিত। হাইকোর্টের প্রধান কাজ হলো ন্যায়বিচার প্রদান, আইন রক্ষা করা এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত রাখা।

হাইকোর্টের ক্ষমতাকে মূলত তিন ভাগে বিভক্ত করা যায় —

  • মূল ক্ষমতা (Original Jurisdiction)
  • আপিল ক্ষমতা (Appellate Jurisdiction)
  • অধীক্ষা ও তত্ত্বাবধানমূলক ক্ষমতা (Supervisory Jurisdiction)

এছাড়াও হাইকোর্টের কিছু বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে, যেমন রিট জারি করার ক্ষমতা ও Court of Record হিসেবে কাজ করার ক্ষমতা। নিচে এগুলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো-

মূল ক্ষমতা (Original Jurisdiction):

হাইকোর্ট সরাসরি কিছু মামলার বিচার করতে পারে, যেগুলি প্রথমবার আদালতে আসে।
এই ক্ষমতার আওতায় —

  • রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা সাংবিধানিক মামলা হাইকোর্টে দায়ের করা যায়।
  • নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে হাইকোর্ট সরাসরি মামলা গ্রহণ করতে পারে।
  • কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট কিছু সীমিত পরিসরে শুনানি করতে পারে।
  • সংবিধানের ধারা ২২৬ অনুযায়ী, হাইকোর্ট নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য রিট (Writ) জারি করতে পারে।

আপিল ক্ষমতা (Appellate Jurisdiction):

হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি করতে পারে।
এই ক্ষমতার মাধ্যমে —

  • জেলা আদালত, সেশন কোর্ট বা পরিবার আদালতের দেওয়া রায় হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা যায়।
  • দেওয়ানি, ফৌজদারি ও সাংবিধানিক মামলার আপিল হাইকোর্টে শোনা হয়।
  • কোনো নিম্ন আদালতের রায়ে আইনগত ত্রুটি থাকলে হাইকোর্ট তা সংশোধন করতে পারে।

অধীক্ষা ও তত্ত্বাবধানমূলক ক্ষমতা (Supervisory Jurisdiction):

হাইকোর্ট রাজ্যের সকল নিম্ন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমের উপর নজরদারি চালায়।

  • নিম্ন আদালতের বিচারপ্রক্রিয়া সঠিকভাবে চলছে কিনা, তা পর্যালোচনা করার অধিকার হাইকোর্টের রয়েছে।
  • প্রয়োজনে নিম্ন আদালতের আদেশ বাতিল বা সংশোধন করতে পারে।
  • নিম্ন আদালতের প্রশাসনিক কাজেও হাইকোর্ট নির্দেশ দিতে পারে।

রিট জারি করার ক্ষমতা (Writ Jurisdiction):

সংবিধানের ধারা ২২৬ অনুসারে, হাইকোর্ট নাগরিকদের মৌলিক অধিকার বলবৎ করতে পাঁচ ধরনের রিট (Writ) জারি করতে পারে —

  • Habeas Corpus: বেআইনি আটক থেকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ।
  • Mandamus: কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষকে তার দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা।
  • Prohibition: নিম্ন আদালতকে তার ক্ষমতার সীমা অতিক্রম না করার নির্দেশ।
  • Certiorari: নিম্ন আদালতের রায় বাতিল বা সংশোধনের নির্দেশ।
  • Quo Warranto: বেআইনিভাবে পদে বসা ব্যক্তিকে সেই পদ থেকে অপসারণের নির্দেশ।

Court of Record হিসেবে ক্ষমতা:

সংবিধানের ধারা ২১৫ অনুযায়ী, প্রত্যেক হাইকোর্ট একটি Court of Record। এর অর্থ —

  • হাইকোর্টের সমস্ত সিদ্ধান্ত, রায় ও আদেশ প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গণ্য হয়।
  • হাইকোর্ট নিজেই Contempt of Court বা আদালত অবমাননা মামলার বিচার করতে পারে।

অন্যান্য বিশেষ ক্ষমতা:

  • হাইকোর্ট বিচারপতিদের বদলিকরণ বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত বিষয়ে নির্দেশ দিতে পারে।
  • রাষ্ট্রপতির বা রাজ্যপালের পরামর্শে কোনো সাংবিধানিক প্রশ্নে মতামত প্রদান করতে পারে।
  • রাজ্যের পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করতে পারে।

হাইকোর্টের বিচারপতিদের পদচ্যুতি:

সংসদের উভয় কক্ষে উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনে প্রস্তাব গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতি হাইকোর্টের বিচারপতিকে পদচ্যুত করতে পারেন। পদচ্যুতির কারণ সাধারণত অসদাচরণ বা অক্ষমতা।

হাইকোর্টের বিচারপতিদের বদলিকরণ:

ধারা ২২২ অনুসারে রাষ্ট্রপতি বিচারপতিদের এক হাইকোর্ট থেকে অন্য হাইকোর্টে বদলি করতে পারেন। ১৯৯৩ সালের সুপ্রীম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় অনুযায়ী, এই বদলিকরণের ক্ষেত্রে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পরামর্শই চূড়ান্ত

উপসংহার:

ভারতের বিচারব্যবস্থায় হাইকোর্ট একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তর। এটি জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা, বিচার ব্যবস্থার শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং আইন ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংবিধান হাইকোর্টকে এমনভাবে গঠিত করেছে যাতে এটি ন্যায়বিচারের শেষ রক্ষাকবচ হিসেবে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে।

GKpathya.in হল সাধারণ জ্ঞান, সমসাময়িক বিষয় ও পরীক্ষামুখী তথ্যের ভাণ্ডার। আমি সুকান্ত দাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এম.এ এবং পেশায় শিক্ষক। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ও শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে সহায়তা করার জন্য সহজ ও নির্ভরযোগ্য কনটেন্ট শেয়ার করি।

Post Comment

error: Content is protected !!