থর্নডাইকের শিখন সূত্র ও শিক্ষা ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব: Thorndike’s Laws of Learning in Education.
ভূমিকা:
শিক্ষণ একটি মানসিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে মানুষ তার আচরণ, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার পরিবর্তন ঘটায়। আধুনিক মনোবিজ্ঞানে শেখার প্রক্রিয়াকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করার অন্যতম পথপ্রদর্শক ছিলেন এডওয়ার্ড লি থর্নডাইক (Edward L. Thorndike)। তিনি প্রাণীদের উপর গবেষণা করে শেখার কিছু মৌলিক সূত্র প্রবর্তন করেন, যা “Trial and Error Method” বা চেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শেখা পদ্ধতি নামে পরিচিত। থর্নডাইকের এই সূত্রগুলি আজও শিক্ষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
থর্নডাইকের শিখন সূত্র:
থর্নডাইক শেখার প্রক্রিয়াকে তিনটি প্রধান সূত্রের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন —
প্রস্তুতির সূত্র (Law of Readiness):
যখন একজন ব্যক্তি মানসিক ও শারীরিকভাবে শেখার জন্য প্রস্তুত থাকে, তখন শেখা সহজ ও আনন্দদায়ক হয়। প্রস্তুতি না থাকলে শেখা বিরক্তিকর মনে হয়। অর্থাৎ, শিক্ষার্থী যখন শেখার মানসিক অবস্থায় থাকে, তখন শিক্ষাদান ফলপ্রসূ হয়।
অনুশীলনের সূত্র (Law of Exercise):
এই সূত্র অনুসারে, যত বেশি অনুশীলন করা হবে, শেখা তত বেশি স্থায়ী হবে। আবার অনুশীলন বন্ধ হয়ে গেলে শেখা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়। এই সূত্র শেখায় যে “Practice makes a man perfect.” তাই শিক্ষা প্রক্রিয়ায় পুনরাবৃত্তি অত্যন্ত জরুরি।
ফলাফলের সূত্র (Law of Effect):
যে কাজের ফলাফল আনন্দদায়ক হয়, ব্যক্তি সেই কাজ পুনরায় করতে চায়; আর যে কাজের ফলাফল অপ্রিয়, সেটি এড়িয়ে চলে। সুতরাং শেখার ক্ষেত্রে আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা ও উৎসাহ সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
উপরের তিনটি প্রধান সূত্রের পাশাপাশি থর্নডাইক আরও কয়েকটি সহায়ক সূত্র প্রস্তাব করেন, যেমন —
- বহু প্রতিক্রিয়া সূত্র (Law of Multiple Response): শেখার সময় ব্যক্তি বারবার চেষ্টা করে সঠিক পদ্ধতি খুঁজে পায়।
- মনোযোগ সূত্র (Law of Selective Attention): ব্যক্তি সেই দিকেই মনোযোগ দেয় যেখানে সফলতার সম্ভাবনা বেশি।
- অভিজ্ঞতা স্থানান্তর সূত্র (Law of Associative Shifting): একবার শেখা কোনো আচরণ অন্য পরিস্থিতিতেও প্রয়োগ করা যায়।
শিক্ষা ক্ষেত্রে থর্নডাইকের সূত্রগুলির গুরুত্ব:
থর্নডাইকের শেখার সূত্রগুলি কেবল মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই নয়, শিক্ষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাঁর সূত্রগুলি শেখার প্রক্রিয়াকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করে এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও ফলপ্রসূ করে তোলে। নিচে শিক্ষা ক্ষেত্রে এই সূত্রগুলির প্রধান প্রধান গুরুত্ব আলোচনা করা হলো —
শিক্ষার্থীর প্রস্তুতির গুরুত্ব:
থর্নডাইকের প্রস্তুতির সূত্র অনুযায়ী, শেখার জন্য মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি অপরিহার্য। একজন ছাত্র তখনই ভালোভাবে শিখতে পারে যখন সে মানসিকভাবে পাঠ গ্রহণে আগ্রহী ও প্রস্তুত থাকে। তাই শিক্ষককে পাঠদানের আগে শিক্ষার্থীর আগ্রহ, মনোভাব ও মানসিক অবস্থা বোঝা জরুরি।
অনুশীলনের প্রয়োজনীয়তা:
অনুশীলনের সূত্র শেখায় যে বারবার পুনরাবৃত্তি শেখাকে স্থায়ী করে। কোনো বিষয় একবার পড়ে মনে থাকে না, কিন্তু নিয়মিত অনুশীলন করলে তা মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হয়। তাই শিক্ষায় অনুশীলনভিত্তিক কার্যক্রম যেমন পুনরাবৃত্তি, হোমওয়ার্ক, ক্লাস টেস্ট ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পুরস্কার ও উৎসাহের ভূমিকা:
থর্নডাইকের ফলাফলের সূত্র অনুযায়ী, আনন্দদায়ক ফলাফল শেখাকে উৎসাহিত করে। শিক্ষার্থীর সাফল্যের প্রশংসা করলে সে আরও ভালোভাবে শিখতে চায়। তাই শিক্ষককে উচিত ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও পুরস্কারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করা।
অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা:
থর্নডাইকের তত্ত্ব শেখায় যে শেখা বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সবচেয়ে ভালোভাবে ঘটে। শিক্ষার্থীরা যদি পাঠ্যবিষয়কে জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে পারে, তবে তা স্থায়ীভাবে মনে থাকে। সুতরাং শিক্ষা ব্যবস্থায় বাস্তব উদাহরণ ও কার্যকর অভিজ্ঞতার সংযোজন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষার উন্নয়ন:
প্রত্যেক শিক্ষার্থীর শেখার গতি ও মানসিক ক্ষমতা এক নয়। থর্নডাইকের সূত্রগুলো শিক্ষকদের শেখায় যে, একেকজন শিক্ষার্থী অনুযায়ী শিক্ষাদানের কৌশল পরিবর্তন করা উচিত। এর ফলে শিক্ষণ প্রক্রিয়া আরও কার্যকর হয় এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।
সমস্যা সমাধান দক্ষতা বৃদ্ধি:
থর্নডাইক শেখার প্রক্রিয়াকে “চেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শেখা (Trial and Error Learning)” হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। শিক্ষার্থীরা যখন নিজেরাই বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে সমস্যার সমাধান খুঁজে পায়, তখন তাদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং আত্মনির্ভরশীলতা গড়ে ওঠে।
ইতিবাচক শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি:
থর্নডাইকের সূত্রগুলি শিক্ষকদের শেখায় যে, শেখার পরিবেশ আনন্দদায়ক, উৎসাহব্যঞ্জক ও চাপমুক্ত হতে হবে। ইতিবাচক পরিবেশ শিক্ষার্থীর আগ্রহ বাড়ায় এবং শেখার মান উন্নত করে।
শিক্ষাদান পদ্ধতির বৈজ্ঞানিকীকরণ:
থর্নডাইকের গবেষণা শিক্ষাদানকে একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় পরিণত করেছে। তাঁর সূত্র অনুযায়ী শেখা অভ্যাস, অভিজ্ঞতা ও ফলাফলের উপর নির্ভরশীল — যা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছে।
উপসংহার:
থর্নডাইকের শিখন সূত্রগুলি শিক্ষাবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেছে। তাঁর সূত্রগুলি প্রমাণ করে যে শেখা একটি অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও আচরণগত প্রক্রিয়া, যা অনুশীলন, ফলাফল ও প্রস্তুতির উপর নির্ভরশীল। শিক্ষা কার্যক্রমকে সফল করতে শিক্ষকদের উচিত থর্নডাইকের সূত্রগুলি বাস্তবে প্রয়োগ করা। ফলে শিক্ষার্থীরা শুধু জ্ঞান অর্জনই নয়, তা জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতেও সক্ষম হবে।



Post Comment