বিদেশ নীতি নির্ধারণে জাতীয় স্বার্থের গুরুত্ব ও ভূমিকা: role-of-national-interest-in-foreign-policy.
ভূমিকা:
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতি মূলত রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুরুত্বপূর্ণ, তার মধ্যে জাতীয় স্বার্থের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য থাকে তার সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং শান্তিপূর্ণ আন্তর্জাতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা।
জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা:
রাষ্ট্রের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জাতীয় স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বজায় রাখা। যদি একটি দেশ স্বাধীন না থাকে, তবে তা সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে না। স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা রক্ষায় রাষ্ট্রকে সামরিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী হতে হয়। যেহেতু সব রাষ্ট্রের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষমতা সমান নয়, তাই রাষ্ট্রগুলোর সুস্থিতি রক্ষার জন্য প্রায়ই শক্তিশালী ও সম্পদশালী দেশের সাহায্য নেওয়া হয়।
জাতীয় উন্নতি সাধন:
জাতীয় স্বার্থের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক ও শিল্পায়নমূলক উন্নয়ন। একটি দেশ তার কাঁচামাল, উৎপাদিত পণ্য ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানি-রপ্তানি সঠিকভাবে পরিচালনা করলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হয়। সঠিক পরিকল্পনা, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও কার্যকর কূটনীতি গ্রহণের মাধ্যমে একটি দেশ শিল্পোন্নত ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
শান্তিপূর্ণ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা:
জাতীয় স্বার্থের একটি লক্ষ্য হওয়া উচিত শান্তিপূর্ণ ও সহবস্থানমূলক আন্তর্জাতিক পরিবেশ তৈরি করা। তবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো প্রায়ই তাদের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখতে বিরোধ এবং অস্ত্রবিক্রির মাধ্যমে অন্য রাষ্ট্রের উপর প্রভাব বিস্তার করে। তাই উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত রাষ্ট্রগুলিকে তাদের জাতীয় স্বার্থের রক্ষা ও আন্তর্জাতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য খুব সতর্কভাবে বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করতে হয়
রাজনৈতিক মতাদর্শের সামঞ্জস্য:
রাজনৈতিক মতাদর্শও জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এবং সাম্যবাদী রাষ্ট্রের লক্ষ্য, নীতি ও কর্মসূচিতে পার্থক্য থাকে। ফলে রাষ্ট্রগুলোর বৈদেশিক নীতি এবং আন্তর্জাতিক অবস্থানও ভিন্ন হয়। তাই রাষ্ট্রগুলোর কূটনৈতিক আচরণ ও কৌশল প্রায়ই তাদের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
নিরস্ত্রীকরণ ও পারমাণবিক শক্তি:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে তার সামরিক ক্ষমতার প্রমাণ দেয়। এরপর পৃথিবীর বহু দেশও ধীরে ধীরে পারমাণবিক শক্তিধারী হয়। নিরস্ত্রীকরণ ও অস্ত্রসংকোচন জাতীয় স্বার্থের অন্যতম অংশ হলেও বাস্তবে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর বক্তব্যে সন্দেহ থেকে যায়। উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো প্রায়ই বড় শক্তির প্রভাবে তাদের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করে, যতক্ষণ না বিশ্বে প্রকৃত নিরস্ত্রীকরণ নিশ্চিত হয়।
উপসংহার:
জাতীয় স্বার্থ রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে মূল চালিকা শক্তি। এটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নতি, শান্তিপূর্ণ আন্তর্জাতিক পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, রাজনৈতিক মতাদর্শের সামঞ্জস্য এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ—সব ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিলতায় রাষ্ট্রগুলোর জন্য নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কূটনীতিমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া অপরিহার্য।



Post Comment