আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নে বাস্তববাদী (Realist) মতবাদ: (Realist theory in the study of international relations).
ভূমিকা:
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নের ক্ষেত্রে বাস্তববাদ (Realism) হল সবচেয়ে প্রভাবশালী ও প্রাচীন মতবাদ।
এই মতবাদ আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে “ক্ষমতার রাজনীতি” বলে বিবেচনা করে। বাস্তববাদীদের মতে, রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রধান একক, এবং প্রতিটি রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হল নিজের জাতীয় স্বার্থ (National Interest) ও নিরাপত্তা (Security) রক্ষা করা।
এই তত্ত্ব বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে, যেখানে ক্ষমতা, প্রতিযোগিতা ও নিরাপত্তা প্রধান ভূমিকা পালন করে।
বাস্তববাদের ঐতিহাসিক পটভূমি:
বাস্তববাদী চিন্তাধারার সূচনা প্রাচীন যুগেই দেখা যায়। থুসিডিডিস (Thucydides) তাঁর History of the Peloponnesian War গ্রন্থে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে শক্তির প্রতিযোগিতা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। পরবর্তীকালে নিকোলো মেকিয়াভেলি (Niccolò Machiavelli) তাঁর The Prince গ্রন্থে বলেন যে, রাজনীতিতে নৈতিকতা নয়, বরং বাস্তবতা ও ক্ষমতাই প্রধান। টমাস হবস (Thomas Hobbes) মানব প্রকৃতিকে স্বার্থান্ধ বলে ব্যাখ্যা করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে সংঘাতপূর্ণ বলেছিলেন। আধুনিক যুগে হান্স মরগেনথো (Hans J. Morgenthau) বাস্তববাদকে একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন এবং ছয়টি মৌলিক নীতি নির্ধারণ করেন।
বাস্তববাদের মূল বক্তব্য:
রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রধান একক:
বাস্তববাদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্তা।
রাষ্ট্রই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং তার কোনো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নেই।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো কেন্দ্রীয় সরকার না থাকায় রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থে পরিচালিত হয়।
জাতীয় স্বার্থই রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি:
প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য তার সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন রক্ষা করা।
এই কারণেই রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি সর্বদা জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে গঠিত হয়।
ক্ষমতা আন্তর্জাতিক রাজনীতির চালিকাশক্তি:
বাস্তববাদীরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি মূলত ক্ষমতার ভারসাম্যের ওপর নির্ভরশীল।
শক্তিশালী রাষ্ট্র দুর্বল রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এই ক্ষমতার প্রতিযোগিতার ওপর গড়ে ওঠে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি এক সংঘাতপূর্ণ ক্ষেত্র:
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো সর্বোচ্চ আইন বা নৈতিক কর্তৃপক্ষ নেই।
ফলে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা ও সংঘর্ষ অনিবার্য।
এই কারণে বাস্তববাদীরা আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে “সংঘর্ষের রাজনীতি” বলে বর্ণনা করেছেন।
নৈতিকতা ও আদর্শ গৌণ:
বাস্তববাদীদের মতে, রাজনীতিতে নৈতিকতা বা আদর্শ নয়, বরং বাস্তবতা ও স্বার্থই মুখ্য।
রাষ্ট্র নৈতিকতার জন্য নয়, নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করে।
যুদ্ধ ও শান্তি উভয়ই রাষ্ট্রের কৌশল:
বাস্তববাদীরা মনে করেন, যুদ্ধ জাতীয় স্বার্থ রক্ষার একটি বৈধ উপায়।
যখন শান্তি রাষ্ট্রের স্বার্থে সহায়ক হয়, তখন রাষ্ট্র শান্তি বজায় রাখে;
কিন্তু প্রয়োজনে যুদ্ধেও অবতীর্ণ হয়।
প্রধান বাস্তববাদী চিন্তাবিদ:
১. থুসিডিডিস (Thucydides)
২. নিকোলো মেকিয়াভেলি (Niccolò Machiavelli)
৩. টমাস হবস (Thomas Hobbes)
৪. হান্স মরগেনথো (Hans J. Morgenthau)
বাস্তববাদের সীমাবদ্ধতা:
যদিও বাস্তববাদ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ব্যাখ্যায় কার্যকর, তবুও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে —
- এটি নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধকে অবমূল্যায়ন করে।
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, জাতিসংঘের ভূমিকা ইত্যাদির গুরুত্ব উপেক্ষা করে।
- যুদ্ধ ও সংঘাতকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়ে বিশ্বশান্তির পথে বাধা সৃষ্টি করে।
উপসংহার:
বাস্তববাদ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নের একটি বাস্তবভিত্তিক ও প্রভাবশালী তত্ত্ব। এটি রাষ্ট্রের শক্তি, স্বার্থ ও নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করে বিশ্ব রাজনীতি বিশ্লেষণ করে। যদিও বাস্তববাদ মানবতাবাদ ও সহযোগিতার ধারণাকে যথাযথ গুরুত্ব দেয় না, তবুও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বোঝার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। আজও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতা বিশ্লেষণে বাস্তববাদ একটি কার্যকর দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে রয়ে গেছে।
Post Comment