আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, সীমাবদ্ধতা ও মূল্যায়ন: Behavioural Approach: Definition, Characteristics, Limitations and Evaluation.

আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, সীমাবদ্ধতা ও মূল্যায়ন: Behavioural Approach: Definition, Characteristics, Limitations and Evaluation.

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি (Behavioural Approach) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনার পরিবর্তে মানুষের রাজনৈতিক আচরণকে ব্যাখ্যার কেন্দ্রস্থলে আনার ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গির অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চার্লস মেরিয়াম, ডেভিড ট্রুম্যান, হার্বাট সাইমন, ডেভিড ইস্টন, রবার্ট ডাল, গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড প্রমুখ পণ্ডিত এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান প্রবক্তা।

আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সংজ্ঞা:

সহজভাবে বলতে গেলে—
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিশ্লেষণে প্রতিষ্ঠান, কাঠামো বা আইন নয়; বরং ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর রাজনৈতিক আচরণ, অভিজ্ঞতা, সংখ্যায়ন, সমাজবিজ্ঞানের উপাত্ত, ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করাকেই আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বলা হয়।

  • ডেভিড ইস্টন আচরণবাদকে বৌদ্ধিক প্রবণতানির্দিষ্ট বিদ্যাগত আন্দোলন বলেছেন।
  • রবার্ট ডাল বলেছেন, আচরণবাদ হল এমন একটি আন্দোলন যা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ও ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার পরিবর্তে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণের মাধ্যমে রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করতে চায়।

আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য:

মূল্য–নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ:

আচরণবাদীরা রাজনৈতিক আলোচনাকে মূল্যবোধ—ভালো–মন্দ, উচিত–অনুচিত—এসব থেকে মুক্ত রাখতে চান।
বিজ্ঞানসম্মত গবেষণার জন্য মূল্যনিরপেক্ষতা জরুরি বলে তারা মনে করেন।

বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির ব্যবহার:

আচরণবাদীদের মতে রাজনৈতিক বিশ্লেষণেও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে—
যেমন:

  • তথ্য সংগ্রহ
  • সংখ্যা বিশ্লেষণ
  • অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ
  • তত্ত্ব যাচাই

এতে গবেষণা আরো নির্ভরযোগ্য হয়।

ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আচরণের ওপর জোর:

আচরণবাদীদের মতে রাজনীতি বিশ্লেষণের মূল ভিত্তি হলো মানুষের আচরণ।
ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর চিন্তা, মনোভাব, পছন্দ–অপছন্দ, ভোটাভ্যাস, নেতৃত্ব ইত্যাদিকে প্রধান গবেষ্য বিষয় করা হয়।

আন্তঃসামাজিক বিজ্ঞান সহযোগিতা:

সমাজতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, নৃতত্ত্ব, পরিসংখ্যান প্রভৃতি শাস্ত্রের সাহায্যে রাজনীতি ব্যাখ্যার ওপর আচরণবাদ জোর দেয়।
তাদের মতে সামাজিক বিজ্ঞানগুলি আন্তঃনির্ভরশীল।

বাস্তবতা–বর্জিত মনোভাব:

আচরণবাদীরা তথ্য ও তত্ত্ব নির্মাণে এতটাই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মনোযোগী যে অনেক সময় সিদ্ধান্তের বাস্তব প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে ভাবেন না।

আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা:

মূল্যবোধের অস্বীকার:

রাজনৈতিক বিশ্লেষণে মূল্যবোধকে বাদ দেওয়াকে অযৌক্তিক বলা হয়।
কারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞান এমন একটি শাস্ত্র যেখানে নৈতিকতা, ন্যায়–অন্যায়, মূল্যবোধকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া অসম্ভব।

বিজ্ঞানসম্মত হতে ব্যর্থ:

আচরণবাদীরা রাজনৈতিক বিশ্লেষণে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পদ্ধতি প্রয়োগ করতে চাইলেও—
মানবসমাজের জটিলতা ও পরিবর্তনশীলতার কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পুরোপুরি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো হতে পারে না।

মানবসমাজের সামগ্রিক সত্ত্বার অবহেলা:

আচরণবাদীরা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আচরণের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দেন।
ফলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, মতাদর্শ, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট—যা মানবসমাজের সামগ্রিক ছবিকে গড়ে তোলে—তা উপেক্ষিত হয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বাতন্ত্র্য সংকট:

সমাজতত্ত্ব, পরিসংখ্যান, মনোবিজ্ঞান প্রভৃতির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারাতে থাকে।

বাস্তব উপযোগিতার অভাব:

আচরণবাদে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হলেও বাস্তবে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে এর তেমন কার্যকারিতা দেখা যায়নি।

মূল্যায়ন:

সমালোচনা থাকলেও রাষ্ট্রচিন্তায় আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
কারণ—

  • এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বৈজ্ঞানিক মনোভাব এনেছে,
  • রাজনৈতিক আচরণ ও উপাত্তভিত্তিক বিশ্লেষণের সূচনা করেছে,
  • গবেষণায় আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার শুরু করেছে।

রাজনৈতিক আচরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আচরণবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।

GKpathya.in হল সাধারণ জ্ঞান, সমসাময়িক বিষয় ও পরীক্ষামুখী তথ্যের ভাণ্ডার। আমি সুকান্ত দাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এম.এ এবং পেশায় শিক্ষক। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ও শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে সহায়তা করার জন্য সহজ ও নির্ভরযোগ্য কনটেন্ট শেয়ার করি।

error: Content is protected !!