ইউরোপীয়দের ভারত আগমন | European Arrival in India.
ভূমিকা (Introduction)
ভারতের ইতিহাসে ইউরোপীয়দের আগমন এক যুগান্তকারী ঘটনা।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ছিলেন প্রথম ইউরোপীয় যিনি ভারত আক্রমণ করেন, কিন্তু ১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামা-র কালিকটে আগমন ছিল ভারতের উপমহাদেশে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার সূচনা।
প্রথমে ইউরোপীয়রা ভারতে আসে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে, কিন্তু পরবর্তীতে তারা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
এর মধ্যে ইংরেজরাই শেষ পর্যন্ত সফল হয় এবং ভারতকে করে তোলে তাদের “Jewel in the Crown”।
পর্তুগিজদের আগমন (Arrival of the Portuguese in India)
ভাস্কো দা গামার আবিষ্কার
- ভাস্কো দা গামা ১৪৯৮ সালের ১৭ মে কেপ রুট হয়ে কালিকট বন্দরে পৌঁছান।
- এটি ছিল ইউরোপ থেকে ভারতে সমুদ্রপথে আগমনের প্রথম সাফল্য।
পর্তুগিজদের বাণিজ্য কেন্দ্র ও প্রশাসন
- বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপিত হয় কালিকট, কোচিন ও কান্নানর-এ।
- কোচিন ছিল প্রথম রাজধানী; পরবর্তীতে গোয়া রাজধানী হয়।
- ফ্রান্সিসকো ডি আলমেদা (১৫০৫–১৫০৯) “নীল জলের নীতি (Blue Water Policy)” প্রচলন করেন।
- আলফোনসো ডি আলবুকার্ক (১৫০৯–১৫১৫) “সাম্রাজ্যবাদের নীতি (Imperial Policy)” চালু করেন এবং ১৫১০ সালে গোয়া দখল করেন।
- নিনো দা কুনহা (১৫৩০) রাজধানী গোয়ায় স্থানান্তর করেন এবং দিউ ও বাসেন অধিগ্রহণ করেন।
- সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার, বিখ্যাত জেসুইট ধর্মপ্রচারক, এই সময় ভারতে আসেন।
পতনের কারণ
- ১৬ শতকের শেষে পর্তুগিজ শক্তির পতন ঘটে।
- ১৬৩১ সালে শাহজাহানের আমলে হুগলি থেকে বিতাড়িত হয়।
- ১৬৬১ সালে বোম্বে ইংল্যান্ডের হাতে যৌতুক হিসেবে হস্তান্তরিত হয়।
- ১৭৩৯ সালে মারাঠারা সালসেট ও বাসেন দখল করে।
- শেষ পর্যন্ত পর্তুগিজরা কেবল গোয়া, দিউ ও দমন ধরে রাখতে পারে, যা ১৯৬১ সাল পর্যন্ত তাদের দখলে ছিল।
ডাচদের আগমন (Arrival of the Dutch)
- ১৬০২ সালে ডাচ পার্লামেন্ট ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে।
- তারা নিম্নলিখিত স্থানে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করে:
- ১৬০৫ – মাসুলিপটম
- ১৬১০ – পুলিকাট
- ১৬১৬ – সুরাট
- ১৬৪১ – বিমলিপটম
- ১৬৪৫ – করাইকাল
- ১৬৫৩ – চিনসুরা
- ১৬৬৩ – কোচিন
- ১৭শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ডাচরা পর্তুগিজদের প্রতিস্থাপন করে পূর্ব বাণিজ্যে প্রভাবশালী শক্তি হয়।
- নেগাপটম ছিল তাদের প্রধান কেন্দ্র (১৬৯০ থেকে)।
- ১৭৫৯ সালে বেদের যুদ্ধের পর তারা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়।
ইংরেজদের আগমন (Arrival of the British in India)
- ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় “The Governor and Company of Merchants of London Trading into the East Indies” নামে।
- ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হকিন্স (১৬০৯) জাহাঙ্গীরের দরবারে গিয়ে সুরাটে কারখানা স্থাপনের অনুমতি চান।
- ১৬১৩ সালে জাহাঙ্গীরের ফরমান দ্বারা সুরাটে ইংরেজদের কারখানা স্থাপিত হয়।
- স্যার থমাস রো (১৬১৫–১৬১৯) সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে ইংল্যান্ডের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে উপস্থিত হন।
- ইংরেজরা বোম্বে দ্বিতীয় চার্লসের কাছ থেকে ইজারা নেয়।
- জব চার্নক (১৬৯০) সুতানাটি, কালিকাটা ও গোবিন্দপুরে কারখানা স্থাপন করেন; এই তিনটি গ্রাম একত্র হয়ে কলকাতা গড়ে ওঠে এবং ফোর্ট উইলিয়াম (১৭০০) নির্মিত হয়।
- ১৭০৮ সালে কোম্পানি একত্রীকরণের পর নাম হয় “The United Company of Merchants of England Trading to the East Indies”।
- কোম্পানির শাসন অব্যাহত থাকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত, এরপর ভারত আসে ব্রিটিশ ক্রাউনের সরাসরি শাসনে।
ফরাসিদের আগমন (Arrival of the French in India)
- ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (French East India Company) ১৬৬৪ সালে কোলবার্ট প্রতিষ্ঠা করেন।
- ফ্রাঁসোয়া ক্যারন (১৬৬৮) সুরাটে প্রথম ফরাসি কারখানা স্থাপন করেন।
- ১৬৬৯ সালে মাসুলিপটামে পরবর্তী কারখানা স্থাপন করা হয়।
- গভর্নর লেনোয়ার ও ডুমাস (১৭২০–১৭৪২)-এর সময় ফরাসি শক্তি পুনরুজ্জীবিত হয়।
- ফরাসিরা মাহে, ইয়ানাম ও করাইকাল দখল করে।
- ডুপ্লেক্স (১৭৪২) ভারতে আগমনের পর শুরু হয় অ্যাংলো-ফরাসি কর্ণাটক যুদ্ধ, যার ফলে ফরাসিদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে।
অ্যাংলো-ফরাসি কর্ণাটক যুদ্ধ (Anglo-French Carnatic Wars)
প্রথম যুদ্ধ (১৭৪৬–১৭৪৮)
- ফরাসিরা মাদ্রাজ অবরোধ করে।
- সেন্ট থোম যুদ্ধ-এ নবাবের সেনা ফরাসিদের কাছে পরাজিত হয়।
- Aix-la-Chapelle (১৭৪৮) চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
দ্বিতীয় যুদ্ধ (১৭৪৯–১৭৫৪)
- ডুপ্লেক্স হায়দরাবাদের মুজাফফর জং ও কর্ণাটকের চান্দা সাহেব-এর সঙ্গে যুক্ত হন।
- শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ ফরাসিদের পরাজিত করেন।
উপসংহার (Conclusion)
ইউরোপীয়দের আগমন প্রথমে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে হলেও পরবর্তীতে তা রাজনৈতিক আধিপত্য ও ঔপনিবেশিক শাসনে পরিণত হয়।
পর্তুগিজরা সূচনা করে, কিন্তু ইংরেজরা আধিপত্য স্থাপন করে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে।
এই দীর্ঘ ঔপনিবেশিক অধ্যায়ের অবসান ঘটে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা এবং ১৯৬১ সালে গোয়া মুক্তির মধ্য দিয়ে।
Post Comment