বিশ্বায়ন: অর্থ, প্রকৃতি ও তাৎপর্য (Globalization: Meaning, Nature and Significance).
বিশ্বায়ন কাকে বলে?
বর্তমান যুগ হলো তথ্য ও প্রযুক্তির যুগ। এক প্রান্তের ঘটনা মুহূর্তেই পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পৌঁছে যায়। এই বৈশ্বিক সংযোগের প্রক্রিয়াকেই বলা হয় বিশ্বায়ন। ইংরেজি শব্দ Globalization-এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো বিশ্বায়ন বা ভুবনায়ন। এর অর্থ হচ্ছে পৃথিবীর নানাদেশের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাধাকে দূর করে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে একক বিশ্বের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করা। অধ্যাপক রবার্টসন প্রথম “বিশ্বায়ন” ধারণাটির প্রবর্তক। ১৯৬০-এর দশকে এর সূচনা এবং ১৯৮০-এর দশকে ব্যাপক প্রচার ঘটে। ভারতের প্রেক্ষাপটে ১৯৯১ সালের পর এই প্রক্রিয়ার বাস্তব প্রয়োগ শুরু হয়।
বিশ্বায়নের প্রকৃতি:
বিশ্বায়নের প্রকৃতি বহুমাত্রিক — অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত দিক থেকে এর প্রভাব পড়েছে বিশ্বব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে।
বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক দিক:
বিশ্বায়নের ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে অর্থ, প্রযুক্তি ও বিনিয়োগের আদানপ্রদান সহজ হয়েছে। বহুজাতিক সংস্থাগুলি এখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্বাধীনভাবে পুঁজিনিবেশ করছে। কিন্তু এর ফলে আর্থিক বৈষম্যও বেড়েছে। উন্নত দেশগুলো আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে, আর অনুন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছে। কারখানা বন্ধ হয়ে শ্রমিকরা বেকার হচ্ছে, কৃষকরা দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ছে। ফলে বিশ্বজুড়ে এক অদৃশ্য আর্থিক বৈষম্য ও মন্দার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
বিশ্বায়নের রাজনৈতিক দিক:
রাজনৈতিকভাবে বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের স্বায়ত্তশাসনের পরিপন্থী। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের স্বার্থে পুঁজির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, কিন্তু বিশ্বায়নের ফলে সেই ক্ষমতা ক্রমশ কমছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান যেমন IMF, World Bank, WTO ইত্যাদি এখন অনেক দেশের নীতি নির্ধারণে প্রভাব ফেলে। ফলে জাতীয় রাজনীতির ওপর আন্তর্জাতিক পুঁজির কর্তৃত্ব বেড়ে চলেছে। জোসেফ নাই এবং জন ডি. জোনাহিউ তাদের “Governance in a Globalized World” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, বিশ্বায়ন মূলধনের গতিশীলতা ও সরকারের ভূমিকা পুনর্নির্ধারণ করেছে।
বিশ্বায়নের সাংস্কৃতিক দিক:
বিশ্বায়নের সাংস্কৃতিক দিকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইন্টারনেট, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতি পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে স্থানীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। একই ধরণের পোশাক, ভাষা, খাবার ও বিনোদনের প্রসার ঘটছে — যা একটি একরূপ বৈশ্বিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। তবে এও বলা যায়, তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে বিশ্ব এখন একে অপরের কাছাকাছি এসেছে।
বিশ্বায়নের পরিবেশগত দিক:
বহুজাতিক সংস্থাগুলির শিল্পকারখানার কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্জ্য, গ্যাস ও রাসায়নিক পদার্থ নদী, মাটি ও বায়ুকে দূষিত করছে। যদিও উন্নত দেশগুলির চাপের ফলে পরিবেশ রক্ষার কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
বিশ্বায়নের তাৎপর্য:
বিশ্বায়ন মানব সমাজে বিভিন্ন দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ:
- অর্থনৈতিক উন্নয়ন: নতুন বাজার, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
- সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি: বিভিন্ন দেশের মানুষ একে অপরের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারছে, যা সহনশীলতা ও ভিন্নতার প্রতি সম্মান বাড়ায়।
- তথ্য ও প্রযুক্তি বিস্তার: দ্রুত ও সহজ তথ্যপ্রবাহ সমাজকে আরও জ্ঞানভিত্তিক ও দক্ষ করছে।
- রাজনৈতিক সহযোগিতা: আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে দেশগুলো একে অপরের সাথে সমন্বয় করছে।
- সামাজিক উন্নয়ন: শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জীবনমান উন্নয়নে সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশ্বায়ন একদিকে যেমন মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগ, প্রযুক্তি ও তথ্যের অগ্রগতি এনেছে, তেমনি অন্যদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক একরূপতা ও পরিবেশ দূষণের মতো সমস্যাও তৈরি করেছে। তাই বিশ্বায়নের সুফল গ্রহণ করতে হলে এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক দিকনির্দেশনায় পরিচালিত হলে বিশ্বায়ন মানবসমাজকে এক সমৃদ্ধ, ন্যায়নিষ্ঠ ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে পারে।
Post Comment