শিখন কাকে বলে? শিখনের বৈশিষ্ট্য ও স্তরগুলি আলোচনা করো। (What is learning? Discuss the characteristics and levels of learning).

শিখন কাকে বলে? শিখনের বৈশিষ্ট্য ও স্তরগুলি আলোচনা করো। (What is learning? Discuss the characteristics and levels of learning).

শিখন কাকে বলে?

শিখন (Learning) হল এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা, অনুশীলন ও পরিবেশের প্রভাবে মানুষের আচরণে স্থায়ী পরিবর্তন ঘটে। এটি কেবল জ্ঞান অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং মনোভাব, মূল্যবোধ, অভ্যাস এবং আচরণেও পরিবর্তন আনে।

মনোবিজ্ঞানী ক্রো ও ক্রো (Crow & Crow)-এর মতে—

“Learning is the acquisition of habits, knowledge and attitudes.”

অর্থাৎ, শিখন হল অভ্যাস, জ্ঞান ও মনোভাব অর্জনের প্রক্রিয়া। এটি মানুষের মানসিক বিকাশ ও সামাজিক অভিযোজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শিখনের বৈশিষ্ট্যসমূহ:

উদ্দেশ্যমুখী প্রক্রিয়া:

প্রত্যেক শিখনের পেছনে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে। এই উদ্দেশ্যই মানুষকে শেখার প্রেরণা জোগায়। যেমন—পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য অধ্যবসায় করা বা জীবনে সফল হওয়ার জন্য নতুন দক্ষতা অর্জন করা।

বিকাশমান প্রক্রিয়া:

শিখনের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়, যা ব্যক্তি-জীবনের ক্রমবিকাশে সাহায্য করে। শিখন আজীবন চলমান একটি প্রক্রিয়া, যা শিশুকাল থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

অভিযোজনমূলক প্রক্রিয়া:

শিখন ব্যক্তিকে পরিবর্তিত পরিবেশ ও সামাজিক অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে চলতে সাহায্য করে। অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তাকে সমস্যা সমাধানে সক্ষম করে তোলে।

চাহিদানির্ভর প্রক্রিয়া:

মানুষ তার চাহিদা পূরণের জন্য শেখে। যেমন— জীবিকা অর্জনের জন্য কোনো দক্ষতা শেখা বা সমাজে মানিয়ে চলার জন্য সামাজিক নিয়ম শেখা।

আচরণগত পরিবর্তন:

শিখনের ফলেই মানুষের আচরণে পরিবর্তন আসে। যেমন—একটি শিশু যেমন আচরণ করে, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা তাকে ভিন্নভাবে আচরণ করতে শেখায়।

স্থায়ী পরিবর্তন ঘটায়:

শিখনের ফলে যে পরিবর্তন ঘটে তা স্থায়ী। সাময়িক পরিবর্তন যেমন ক্লান্তি বা অসুস্থতার কারণে হয়, তা শিখন নয়।

অনুশীলন সাপেক্ষ:

শিখন অনুশীলনের মাধ্যমে দৃঢ় হয়। পুনরাবৃত্ত অনুশীলন শিখনকে স্থায়ী ও কার্যকর করে তোলে।

ব্যক্তিভেদে পার্থক্যপূর্ণ:

মানসিক ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা, আগ্রহ ও পরিবেশের পার্থক্যের কারণে শিখন ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন হয়।

সক্রিয় প্রক্রিয়া:

শিখনের জন্য ব্যক্তিকে সক্রিয় হতে হয়। কেবল শোনা বা দেখা নয়, সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমেই প্রকৃত শিখন সম্ভব।

পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত:

শিখন সর্বদা পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ফলে ঘটে। অনুকূল পরিবেশ শিখনকে সহজ ও আনন্দদায়ক করে তোলে।

সার্বিক বিকাশে সহায়ক:

শিখনের মাধ্যমে মানুষের মানসিক, সামাজিক, নৈতিক ও শারীরিক বিকাশ ঘটে। তাই এটি সার্বিক বিকাশের অন্যতম উপাদান।

প্রেষণানির্ভর:

শিখনের জন্য প্রেষণা বা অনুপ্রেরণা অপরিহার্য। প্রেষণা ব্যক্তিকে শেখার শক্তি ও আগ্রহ জোগায়।

উপসংহার:

শিখন মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি মানুষকে কেবল জ্ঞানী করে না, বরং সমাজোপযোগী, নৈতিক ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো—মানুষের শিখন ক্ষমতা। এই ক্ষমতার মাধ্যমেই মানুষ সভ্যতা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিতে উন্নতির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছেছে। তাই বলা যায়, শিখনই মানবজীবনের বিকাশ ও সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

শিখনের স্তরসমূহ (Levels of Learning):

শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী  বেনজামিন ব্লুম (Benjamin Bloom)  শিখনকে তিনটি প্রধান স্তরে ভাগ করেছেন। এগুলোকে  Learning Domains বলা হয়। প্রতিটি স্তর শিখনের ভিন্ন দিক প্রকাশ করে।

জ্ঞানমূলক স্তর (Cognitive Domain):

এটি মানুষের  চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত। এখানে শিখন ঘটে তথ্য, ধারণা, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের মাধ্যমে।

উপস্তরগুলো:

  • জ্ঞান (Knowledge):  তথ্য বা বিষয়বস্তু মনে রাখা।
  • বোধগম্যতা (Comprehension):  শেখা বিষয় বোঝা।
  • প্রয়োগ (Application):  শেখা জ্ঞান বাস্তবে ব্যবহার করা।
  • বিশ্লেষণ (Analysis):  বিষয়কে ভেঙে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করা।
  • সংযোজন (Synthesis):  নতুন ধারণা বা কাজ তৈরি করা।
  • মূল্যায়ন (Evaluation):  জ্ঞান ও পরিস্থিতি বিচার ও মূল্যায়ন করা।

উদাহরণ: গণিত সূত্র ব্যবহার করে সমীকরণ সমাধান করা, ইতিহাসের ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করা।

আবেগমূলক স্তর (Affective Domain):

এটি মানুষের অনুভূতি, মনোভাব, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত।

উপস্তরগুলো:

  • গ্রহণ (Receiving):  শেখার জন্য মনোযোগী হওয়া।
  • প্রতিক্রিয়া (Responding):  শেখা জ্ঞানের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়া।
  • মূল্যায়ন (Valuing):  শেখা জ্ঞানকে গুরুত্ব দেওয়া বা মূল্যবোধের সঙ্গে যুক্ত করা।
  • সংগঠন (Organization):  মানসিক দিক থেকে শেখা জ্ঞানকে একত্রিত করা।
  • চরিত্রায়ন (Characterization):  শেখা মানসিক ও নৈতিক অভ্যাসে রূপান্তরিত হওয়া।

উদাহরণ:  বিদ্যালয়ের নিয়ম মানা, সততা ও সময়ানুবর্তিতা বজায় রাখা।

আচরণমূলক বা কায়িক স্তর (Psychomotor Domain):

এটি  শরীরের দক্ষতা, কৌশল ও শারীরিক ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত।

উপস্তরগুলো:

  • অনুকরণ (Imitation): কাউকে দেখে নির্দিষ্ট কাজ করা শেখা।
  • অনুশীলন (Practice): নিয়মিত চেষ্টা ও অনুশীলনের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন।
  • দক্ষতা (Proficiency):  দক্ষতার সঙ্গে কাজ সম্পন্ন করা।
  • নিপুণতা (Mastery):  শীর্ষ পর্যায়ের দক্ষতা অর্জন।

উদাহরণ: সাঁতার শেখা, চিত্রাঙ্কন, ল্যাব পরীক্ষায় দক্ষতা অর্জন।

উপসংহার:

শিখনের তিনটি স্তর— জ্ঞানমূলক, আবেগমূলক ও কায়িক —একসাথে ব্যক্তির সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করে। জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে মনোভাব ও দক্ষতা বিকাশ পেলে শিক্ষার লক্ষ্য পূরণ হয়।

এই পোষ্টের PDF পেতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন:

GKpathya.in হল সাধারণ জ্ঞান, সমসাময়িক বিষয় ও পরীক্ষামুখী তথ্যের ভাণ্ডার। আমি সুকান্ত দাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এম.এ এবং পেশায় শিক্ষক। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ও শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে সহায়তা করার জন্য সহজ ও নির্ভরযোগ্য কনটেন্ট শেয়ার করি।

Post Comment

error: Content is protected !!