প্রাচীন ভারতের নারীর সামাজিক অবস্থান: (Social status of women in ancient India).

প্রাচীন ভারতের নারীর সামাজিক অবস্থান: (Social status of women in ancient India).

প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থান এক জটিল এবং পরিবর্তনশীল ইতিহাস বহন করে। কখনো তিনি ছিলেন পূজ্য, গৃহের আলো এবং সমাজের পথপ্রদর্শক; আবার কখনো তাকে করা হয়েছে অবহেলার শিকার। ভারতের সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নারীর সামাজিক অবস্থানেও এসেছে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। এই প্রবন্ধে আমরা প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন সময়পর্বে নারীর মর্যাদা, অধিকার ও অবস্থান বিশ্লেষণ করব।

হরপ্পা সভ্যতার যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান:

হরপ্পা সভ্যতার যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্য না পাওয়া গেলেও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভিত্তিতে বহু ঐতিহাসিক এই সভ্যতাকে মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতা বলে উল্লেখ করেছেন। নারীমূর্তির আধিক্য, মাটির তৈরি নানাবিধ অলংকার, নারীদের কবরগুলিতে পুরুষদের তুলনায় মাটির পাত্রের সংখ্যাধিক্য প্রভৃতি থেকে তাদের সামাজিক অবস্থানের পরিচয় পাওয়া যায়।

ঋকবৈদিক যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান:

ঋকবেদের বিভিন্ন স্তোত্র, উক্তি থেকে এ যুগে নারীর মুক্ত জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় কন্যাসন্তানের জন্ম একেবারেই নিন্দনীয় ছিল না। বৈদিক যুগের বহু স্তোত্র রচনায় যেসকল নারীরা অসামান্য পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন— বিশ্ববারা, অপালা, ঘোষা, লোপামুদ্রা প্রমুখ। শাস্ত্রচর্চার পাশাপাশি ঋকবৈদিক যুগের মেয়েদের অস্ত্রচর্চা, পতি নির্বাচনে স্বাধীনতা, ধর্মীয় উৎসব ও যুদ্ধে অংশগ্রহণের অধিকার ছিল।

পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান:

পরবর্তী বৈদিক যুগে রচিত অথর্ব বেদের একটি স্তোত্রে পুত্রসন্তান জন্মের জন্য আনন্দ ও কন্যাসন্তান জন্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। মৈত্রেয়ানী সংহিতায় নারীদের সভাসমিতিতে অংশগ্রহণ ও সম্পত্তির অধিকার প্রদান করা হয়নি। শিক্ষাদীক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার বিধিনিষেধ সত্ত্বেও গার্গী, মৈত্রেয়ীর মতো বিদুষী নারীদের পরিচয় পাওয়া যায়, যা ছিল পরবর্তী বৈদিক যুগের এক উল্লেখেযোগ্য দৃষ্টান্ত।

মহাকাব্যের যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান:

মহাকাব্যের যুগে বিশেষ কতকগুলি ক্ষেত্রে নারীর স্বাধীনচেতা মনোভাব প্রতিফলিত হলেও সামগ্রিকভাবে তাদের সামাজিক অবস্থানের অবনতি লক্ষ করা যায়। রামায়ণে স্ত্রীকে ‘পতিব্রতা’ হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস প্রমাণ করে যে, স্বামীই হল নারীর সত্তা, তার নিজস্ব কোনো সত্তা নেই। অন্যদিকে, মহাভারতে দ্রৌপদীকে পণ হিসেবে রেখে কৌরব ও পাণ্ডবদের পাশাখেলা প্রমাণ করে যে, নারীরা এসময় ভোগ্যবস্তু ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

বৌদ্ধ ও জৈন যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান:

গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর জৈনের প্রচারিত ধর্মে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ছিল অন্যতম আকর্ষণ। গৌতম বুদ্ধ নারী ভিক্ষুণীদের অনুমতি দেন সংঘে প্রবেশের, যদিও কিছু বিধিনিষেধসহ। এই যুগে অনেক নারী ভিক্ষুণী শিক্ষিত হন এবং ধর্মচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন।
তবে সাধারণ হিন্দু সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে খুব বেশি পরিবর্তন দেখা যায় না।

মৌর্য যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান:

মৌর্য যুগে নারীর সমাজিক অবস্থানের কিছুটা উন্নতি ঘটেছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা থেকে জানা যায়, রাজপরিবার ও উচ্চতর বংশের নারীরাই এসময় বিদ্যাচর্চার সুযোগ পেয়েছিল। পরাশর সংহিতা গ্রন্থে নারীর দ্বিতীয়বার বিবাহের বিধান আছে। অন্যদিকে, অর্থশাস্ত্রে স্ত্রীধনের উল্লেখ থেকে জানা যায় যে, মৌর্য যুগের সম্পত্তিতে নারীর অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছিল।

মৌর্য পরবর্তী যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান:

মৌর্য পরবর্তী কুষাণ যুগে নারীর সামাজিক অবস্থা ছিল উন্নত। তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ ছিল। তবে ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল। আবার সাতবাহন আমলে শাসকদের নামের সঙ্গে তাঁর মায়ের নামের সংযুক্তি নারীসমাজের উন্নতির পরিচয় বহন করে।

গুপ্ত যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান:

গুপ্ত যুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সুদৃঢ় ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজে নারীদের সামাজিক অবস্থা ও মর্যাদার অবনমন শুরু হয়। মনুস্মৃতিতে নারী সম্পর্কে বলা হয়েছে, নারী শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্রের দ্বারা আশ্রিত ও রক্ষিত হবে। এই যুগে অভিজাত পরিবারের মহিলারা ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে শাস্ত্রচর্চা নিষিদ্ধ ছিল। এ ছাড়া দেবদাসীদের সংখ্যাবৃদ্ধি নারীর মর্যাদা হ্রাসের পরিচয় বহন করে। তবে সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বলা যায়, গুপ্ত যুগের রাজনীতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য।

প্রাচীন ভারতে নারীর সামাজিক অবস্থান সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। একদিকে যেমন নারীরা একসময় ছিলেন জ্ঞানী, শিক্ষিত এবং সমাজগঠনকারীদের একজন; অন্যদিকে ধীরে ধীরে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তারা অধিকারহীন হয়ে পড়েন।
তবে এটি সত্য যে, নারীর ইতিহাস একপাক্ষিক নয়। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে, দর্শনে এবং ইতিহাসে অনেক নারীর অবদান আজও আলো ছড়ায়। আধুনিক যুগে সেই গৌরবময় অতীত থেকেই নারীর ক্ষমতায়নের প্রেরণা নেওয়া যায়।

GKpathya.in হল সাধারণ জ্ঞান, সমসাময়িক বিষয় ও পরীক্ষামুখী তথ্যের ভাণ্ডার। আমি সুকান্ত দাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এম.এ এবং পেশায় শিক্ষক। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ও শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে সহায়তা করার জন্য সহজ ও নির্ভরযোগ্য কনটেন্ট শেয়ার করি।

Post Comment

error: Content is protected !!