ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে থেকে সমগ্র ভারতবর্ষের জুড়ে যে ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল তা আছড়ে পড়েছিল মুসলিম সমাজের উপরেও। পিছিয়ে পড়া মুসলমান সম্প্রদায়কে যুক্তিবাদী আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য স্যার সৈয়দ আহমদ উত্তর প্রদেশের আলিগড়ে যে আন্দোলনের সূচনা করেন তা আলিগড় আন্দোলন নামে খ্যাত। স্যার সৈয়দ আহমদ ইংরেজি ভাষার মাধমে পাশ্চাত্য শিক্ষাকে প্রগতির যথার্থ সোপান বলে মনে করতেন। তাই তিনি মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রসারে উদ্যোগী হন।
আলীগড় আন্দোলনের পটভূমি:
সৈয়দ আহমেদ খান তার ‘The Loyal Mohamedans' নামক গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে ব্রিটিশ সরকার মহাবিদ্রোহের জন্য মুসলিমদের বেশি দায়ী করে ছিল। অপরদিকে মুসলমানরা ভারত ব্রিটিশ শাসনকালে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তনকে সন্দেহের চোখে দেখত। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়ায় সরকারি চাকরির উচ্চপদগুলি, প্রভাব- প্রতিপত্তি সবদিক থেকে মুসলিম সম্প্রদায় হিন্দুদের তুলনায় অনেক গুণ পিছিয়ে পড়ে। তাই তিনি মুসলমান সমাজকে একথা বোঝান যে ইংরেজ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা ও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের ওপর তার উন্নতি একান্তভাবে নির্ভরশীল। মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য ভাবধারা ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রসারের জন্য সৈয়দ আহমেদ যে কর্মসূচি গ্রহণ করে তা অসাধারণ ভাবে আলীগড় আন্দোলন নামে খ্যাত।
পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের প্রয়াস:
১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে স্যার সৈয়দ আহমেদ মাতৃভাষা উর্দুর মাধ্যমে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রসারের জন্য ‘Sintific Socity' নামে একটি সমিতি স্থাপন করে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ ছিল ইংরেজি ভাষায় রচিত গ্রন্থ গুলি উর্দুতে অনুবাদ করে মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে সহায়তা করা। এই উদ্দেশ্যে স্যার সৈয়দ আহমেদ ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আলিগড়ে ‘Mohamedan Anglo Oriantal Collage' স্থাপন করেছিলেন যা পরবর্তীতে ‘আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়' নামে পরিচিত হয়েছিল। এই কলেজে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছিল আলীগড় আন্দোলন। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি গাজীপুরে একটি ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
স্যার সৈয়দ আহমেদ ও মুসলিম সমাজ সংস্কার:
স্যার সৈয়দ আহমেদ দেশ প্রেমিক হলেও জাতীয় কংগ্রেসকে অত্যন্ত শত্রু বলে মনে করতেন। জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘Mohamadan Education Congres' প্রতিষ্ঠা করেন। এটি পড়ে ‘Mohamadan Education Confarance' নামে পরিচিত হয়। এরপর তিনি গঠন করেন ‘United Petrotyatie Assocaition' (১৮৮৮)। এই সংস্থার প্রধান কাজ ছিল জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতা করা। এরপর তিনি স্থাপন করেন 'Mohamadan Anglo Oriantal difrence' (১৮৬৩)। এই সংগঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল—
- মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা করা।
- ইংরেজ শাসন কে সমর্থন করা।
- ইংরেজ শাসনের প্রতি অধিকতর মুসলমানদের অনুগত সৃষ্টি করা।
আলীগড় আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা:
স্যার সৈয়দ আহমেদ খান মুসলমানদের মধ্যে এই আশঙ্কা প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন যে ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও উন্নততর হিন্দুরা অধিক ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন যে ভারতীয় কংগ্রেস ভারতের সকল সম্প্রদায়ের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হতে পারে না৷ অবশ্য প্রথম দিকে তিনি হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতার কথা প্রচার করেন, তিনি বলেছিলেন যে হিন্দু ও মুসলমান দুটি চক্ষু এর একটি আঘাতপ্রাপ্ত হলে অপরটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু ক্রমশ তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক ও স্বতন্ত্র জাতী ও তাদের স্বার্থ পরস্পর বিরোধী এই দ্বিজাতি তত্ত্বের বীজ রোপন করেন।
আলীগড় আন্দোলনের গুরুত্ব:
স্যার সৈয়দ আহমেদ অনুন্নত সমাজের নবজাগরণ এনেছিলেন এইজন্য তাকে রাজা রামমোহন রায়ের সাথে তুলনা করা হয়। তার কার্যকলাপের ফলে ভারতের রাজনীতিতে মুসলমানদের গুরুত্ব ইংরেজ সরকার ক্রমশ অনুভব করেন। দ্বিজাতি তত্ত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রসারে আলিগড় কলেজের অধ্যাপক থিওডোর ব্রেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি আলিগড় থেকে প্রকাশিত ‘ইনস্টিটিউট গেজেট' নামে সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এতে এমন সব প্রবন্ধ হতে থাকে যার ফলে আরে আলীগড় আন্দোলন ক্রমশ সাম্প্রদায়িকতার পথে অগ্রসর হয়েছিল। এই সাম্প্রদায়িকতার ফলশ্রুতি হিসেবে ভারতবর্ষের বুক ভেদ করে পাকিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।
0 মন্তব্যসমূহ